সোমবার ১৮ gvP© ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement
  • প্রচ্ছদ » sub lead 3 » অসাধু বাড়ির মালিকগণ, অসহায় ভাড়াটিয়া ও কুসিকের ভূমিকা


অসাধু বাড়ির মালিকগণ, অসহায় ভাড়াটিয়া ও কুসিকের ভূমিকা


আমাদের কুমিল্লা .কম :
03.10.2022

শাহাজাদা এমরান ।। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা থাকেন নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকায়। গেল সেপ্টেম্বর মাসে তার বাড়ির মালিককে বাসা ভাড়া দিতে গেলে বাড়িওয়ালা মৃদু হেসে বলে দিলেন,জানুয়ারি মাস থেকে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। বাসার সব ভাড়াটিয়াকে আমি বলে দিয়েছি।’ শিক্ষিকা হঠাৎ করে বাসা ভাড়ার কারণ জানতে চাইলে বাড়িওয়ালা জানালেন, ‘গ্যাস,বিদ্যুৎসহ সব কিছুরই দাম বেড়েছে, তাই আমিও বাড়িয়েছি।’
শিক্ষিকা বললেন, ‘গ্যাসের দাম বেড়েছে, তা তো আমরা দেই। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে তাও আমরা দেই। পানির বিল দেই। ময়লা ফেলার বিলও দেই। বাসার একটা কিছু নষ্ট হলে আমরা কিনে এনে মিস্ত্রি এনে ঠিক করে নেই। আমি আপনার এখানে দুই বছর ধরে আছি। এই দুই বছরে আপনি কি আমার ফ্লাটে এক টাকার কোন কাজ করেছেন।’
বাড়িওয়ালা বললেন, ‘না ভাবি কোন কাজ করাইনি। তাহলে আপনি এক হাজার টাকা কেন বাড়াবেন?’
বাড়িওয়ালা এবার মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘ভাবি, জানুয়ারি থেকে থাকতে চাইলে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতেই হবে।’
এ কথা বলেই তিনি দরজা আটকে দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। এই অভিযোগ শুধু ঐ স্কুল শিক্ষিকার নয়। গত এক সপ্তাহে কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন পেশার প্রায় অর্ধশত কর্মজীবী এই কলাম লেখককে একই অভিযোগ করেছেন। সার্বিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, জানুয়ারি মাস সামনে রেখে বাড়িওয়ালারা বাসা ভাড়া বৃদ্ধির একটি উৎসবে নেমে পড়ছেন।

এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ^াস হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের। আয়ের সাথে কোন ভাবেই মিলাতে পারছে না ব্যায়ের হিসাব। গত কয়েক মাস ধরে অনেক পরিবার তাদের বাজার খরচেই যে শুধু কাটছাট করছে তা নয়, সন্তানের প্রাইভেট টিচারদেরও না করে দিয়েছেন অনেকে। এই সকল গৃহ শিক্ষকরা কিন্তু টিউশনি করে নিজের পড়াশুনার খরচ চালাতো।
এখন অবস্থা দাঁড়ালো, এক দিকে ঐ গৃহ শিক্ষক চাকুরি হারিয়ে বেকার হয়েছেন। বেকার হওয়ার কারণে তার শহরে থাকার খরচসহ পড়াশোনার যাবতীয় খরচ মেটানোর জন্য চাপ দিচ্ছে গ্রামে থাকা তার অসহায় পরিবারকে। এমনিতেই সামান্য কৃষি কাজ কিংবা ছোট কাজ করে সংসারের খরচ নির্বাহ করতে পারছেন না তার অভিভাবক । আবার নতুন করে চাপ এলো শহরে থাকা সন্তানের খরচ দেওয়া জন্য।

অপরদিকে, গৃহ শিক্ষককে না করে দেওয়া অভিভাবকও কিন্তু তার সন্তানকে টাকার অভাবে মানমম্মত শিক্ষা দেয়াতে পারছেন না। জ¦ালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের সমাজ জীবনে আর্থিক টানা পোড়নের যে ভয়াভহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার ওপর নগরীর বাড়িওয়ালাদের বাড়ি ভাড়ার নোটিশ নগরীর ভাড়া থাকা নাগরিকদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা যে শুধু কুমিল্লার তা নয়, সারা বাংলাদেশেরই একই চিত্র।

এমনিতেই দেশের সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকল নিষ্পেষিত হয়ে আছে। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে জ¦ালানি তেলের বৃদ্ধি করায় দ্রব্যমূল্যসহ সব কিছুই বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক ভাবে। এমন একটা সেক্টর নেই যেই সেক্টরে দাম বাড়েনি। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ যে চরমভাবে দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে তা যেন দেখার কোন লোক নেই এই সমাজে।
আমি হলফ করে বলতে পারি, দেশের সরকারি বেসরকারি, স্বপরিচালিত কিংবা স্বায়ত্বশািসত কোথায়ও কোন চাকুরিজীবীর বেতন এক টাকাও বাড়েনি এই সময়ে। বরং কেউ চাকুরি হারিয়েছে কারো বা বেতন কমেছে।যারা দিন মজুরের কাজ করে তাদের অবস্থা তো এখন ‘ত্রাহি মধুসুদন।’
আমরা যারা সংবাদপত্র প্রকাশনার সাথে জড়িত আমরা জানি প্রতিনিয়ত কত যুদ্ধ করে আমাদের পত্রিকা বের করতে হচ্ছে। সরকার বাহাদুর জ¦ালানি তেলের দাম বাড়াতে দেরি হয়েছে কিন্তু আমাদের প্রেসের মালিক পত্রিকা ছাপানোর খরচ বাড়াতে দেরি করেননি। আগস্ট থেকে প্রতিদিন মোট খরচের এক হাজার টাকা বেশি বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে এক টাকার বিজ্ঞাপণ বাড়েনি। এমনকি সরকারি বিজ্ঞাপণের দামও বাড়েনি। আবার ডিজিটাল যুগের কারণে ই-পেপার সাইজে বিজ্ঞাপণ দিয়ে আকার ছোট করা হয়েছে। ব্যাক্তি বা বেসরকারি বিজ্ঞাপণ গুলোও কমে গেছে আশঙ্কাজনক ভাবে। মানুষের আয় না থাকলে তারা বিজ্ঞাপণ দিবে কিভাবে ?

এই যে আমার আয় বাড়লো না তাহলে আমি অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করব কিভাবে ? কোথায় পাব আমি এই অতিরিক্ত টাকা। আমি কি না খেয়ে, জামা কাপড় না পরে থাকতে পারব, তা কি সম্ভব? তার ওপর যদি আগামী জানুয়ারি মাস থেকে বাসা বাড়ির মালিকরা বছরের পর বছর নূন্যতম কোন উন্নয়ন কাজ না করেই বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেয় তাহলে ভুক্তভোগী এই পরিবার গুলো যাবে কোথায়।

নগরীর শতকরা প্রায় ৯৮জন বাড়ির মালিকই ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য যেই টাকা বাড়ি ভাড়া দেয়, তার অর্ধেক কম দেখায়। আবার সব ফ্লোরে কিংবা ফ্লাটে ভাড়াটিয়া থাকলেও সিটি কর্পোরেশনকে বলে, বেশির ভাগই খালি পড়ে আছে, ভাড়াটিয়া নেই। ৯৫জন মালিকই তার ভাড়াটিয়াদের রশিদ দেন না। আবার অনেকেই ভাড়াটিয়াদের বলে দেন, যদি সরকারি ইনকাম ট্যাক্সের লোক আসে বলবেন এত ভাড়া দেই (অথচ তিনি নিচ্ছেন কিন্তু ডাবল ভাড়া) ইত্যাদি।
অসাধু ব্যবসায়ীদের মত এরাও কিন্ত অসাধু বাড়ি মালিক ব্যবসায়ী। তারা একদিকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে অপর দিকে ভাড়াটিয়াদের ওপর ভাড়া বাড়িয়ে জুলুম করছে। এবার এই অসাধু বাড়ির মালিক নামের ব্যবসায়িদের টুঁটি চেপে ধরতে হবে।

আমি কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব আরফানুল হক রিফাত ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব কবি ড. সফিকুল ইসলামের কাছে অনুরোধ করবো, দেশে বাড়ি ভাড়ার যে নির্দিষ্ট একটি আইন আছে, কুমিল্লা সিটিতে সেই আইনের সঠিক প্রয়োগ করুন। যাতে বাড়ির মালিকরা বাড়ির প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারেন। বাড়ি ভাড়া যেন অবশ্যই রশিদের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। এবং অসাধু বাড়ির মালিকরা যেন কোন ভাবেই কুসিকের ট্যাক্স ফাঁকি দিতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করুন।
নগরীতে বসবাস করা বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া সবাই কুমিল্লার নাগরিক। তাদের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব অবশ্যই কুসিক কর্তৃপক্ষের।
আমরা প্রত্যাশা করব, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন উভয়ের স্বার্থ বিবেচনা করে একটি দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভুমিকা পালন করবেন। কুমিল্লা নগরবাসী সেই অপেক্ষায় রইলো।
লেখক : সাংবাদিক, সংগঠক ও কলাম লেখক। ০১৭১১-৩৮৮৩০৮