শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


‘পুকুর-দিঘির শহর’ কুমিল্লা ২৩ বছরেই ‘গায়েব’ হয়েছে শতাধিক পুকুর


আমাদের কুমিল্লা .কম :
20.05.2024

# স্বাধীনতার পরও কুমিল্লায় পুকুরের সংখ্যা ছিলো ৮ শতাধিক
# ভরাটকারীদের তালিকায় আছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও
# লাগামহীনভাবে পুকুরসহ জলাধার ভরাটের কারণে বেড়েছে জলাবদ্ধতা

আবদুর রহমান ।। প্রাচীনকাল থেকেই কুমিল্লা সম্মৃদ্ধ ছিলো ব্যাংক ও ট্যাংকের (পুকুর) শহর হিসেবে। তবে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে কুমিল্লা নগরীতে ব্যাংকের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও একের পর এক ভরাট হয়ে কমেছে পুকুরের সংখ্যা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে- শুধুমাত্র গত ২৩ বছরেই কুমিল্লা শহর এলাকায় ভরাট হয়েছে শতাধিক পুকুরসহ বিভিন্ন জলাশয়। প্রশাসনের চোখের সামনে এসব জলাধার ভরাট হয়ে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কিন্তু রক্ষা হয়নি পুকুরের অস্তিত্ব। তবে শুধুমাত্র বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুমিল্লায় একের পর এক ভরাট হয়েছে পুকুর-জলাশয়।
কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং পরিবেশ রক্ষায় কাজ করেন- এমন কয়েকজন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও শুধুমাত্র কুমিল্লা শহরেই ৮’শর বেশি পুকুর ছিলো। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা ২’শর নিচে হবে। শুধুমাত্র গত ২৩ বছরেই ভরাট হয়েছে শতাধিক পুকুর। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বছরে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে শত বছরের প্রাচীন ১৩৫ শতকের একটি পুকুর পুরোপুরি এবং ১২০ শতকের আরেকটি পুকুরের ৪০ শতাংশ ভরাট করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময় ও বছরগুলোর মধ্যে ভরাট হয়েছে- নগরীর দ্বিতীয় মুরাদপুর এলাকার ২৫০ বছরের পুরাতন ঐতিহাসিক হাতিপুকুরের একাংশ, একই এলাকায় শত বছরের প্রাচীন নারায়ণ পুকুরের উত্তর পাশের ৩৪ শতাংশ, নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীপাড়া ঈদগাঁ ও মসজিদ সংলগ্ন শত বছরের প্রাচীন বড়বাড়ির পুকুর, একই এলাকায় প্রায় ২শ বছরের প্রাচীন কাজীপুকুর, বিভিন্ন সময়ে আংশিক ভরাট হয়েছে তিন ’শ বছরের পুরানো ছোটরা জংলিবিবি পুকুরও। বর্তমানেও পুকুরটি ভরাটের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এছাড়া গত ২৩ বছরের মধ্যে ভরাট হওয়া শতাধিক পুকুরের কয়েকটি হলো- ঝাউতলা খান সাহেবের পুকুর, লাকী হাউসের পুকুর, কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার পাশের দুটি পুকুর, নাদিপা হাউজিং পুকুর, দক্ষিণ চর্থা থিরা পুকুর, নগরীর উত্তর চর্থার তেলিয়া পুকুর, সংরাইশ এলাকার কালীমন্দির পুকুরসহ তিনটি পুকুর, কুমিল্লা অজিত গুহ মহাবিদ্যালয়ের সুপারিবাগানে দুটি পুকুর, দারোগাবাড়িতে বড় আন্দরের পুকুর, কুমিল্লা নগরীর ফরিদা বিদ্যায়তনের দক্ষিণ পাশে জনাদের পুকুর, ঝাউতলা খ্রিস্টান পাড়ার পুকুর, প্রফেসর পাড়ার চারটি পুকুর, কোতয়ালি থানার পেছনের দুটি পুকুর, কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের কয়েকটি পুকুর, ধর্মসাগর দিঘির পাড়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পুকুর।
বিগত সময়ের প্রতিটি ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- ভরাট হওয়ার পর একটি পুকুরও পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি প্রশাসন। লাগামহীনভাবে পুকুরসহ বিভিন্ন জলাধার ভরাটের কারণে বর্তমানে কুমিল্লা নগরীতে আশংকাজনকহারে বেড়েছে জলাবদ্ধতা। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশবিদরা বলেছেন- বাকি যেই কয়টি পুকুর রয়েছে- সেগুলো রক্ষায় এখনই কঠোর হতে হবে প্রশাসনকে। না হলে পুকুরের শহর কুমিল্লায় কোন পুকুরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কুমিল্লা নগরীর ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ঝাউতলা এলাকার খ্রিস্টান পাড়ায় ২০১৫ সালের দিকে ভরাট করা হয়েছে বড় আকৃতির দু’টি পুকুর। এরমধ্যে বর্তমানে একটি পুকুরের ওপর ৫ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করছেন মোহাম্মদ ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি। কীভাবে পুকুরের ওপর ভবন তোলা হচ্ছে, এ তথ্য জানতে সরেজমিন ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে- এরই মধ্যে ভবনটির তিনতলার কাজ শেষ হয়েছে।
তবে বাড়িতে গিয়ে মোহাম্মদ ইউসুফকে পাওয়া যায়নি। পরে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাঁর স্ত্রী রোকসানা আক্তার বলেন, আমার স্বামী প্রবাসী। ২০১৮ সালে এই জমি কিনে বাড়ির কাজ শুরু করেছেন তিনি। এখনো কাজ শেষ হয়নি। রোকসানার দাবি- এই বাড়ি সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়েই নির্মিত হচ্ছে। এই জমিতে আগে পুকুরে ছিলো বলে তারা জেনেছেন; কিন্তু তারা ভরাট করেননি।
পাশেই আরেকটি বড় আকৃতির পুকুর ভরাট করেছেন খোরশেদ আলম নামে এক ব্যক্তির পরিবার। ভরাটের পর এক পাশে নির্মিত হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অন্য পাশে বহুতল ভবন নির্মাণের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে জানতে ভরাটকারীদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া পুকুরের ওপর নির্মিত ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কথা বলতে গেলেও এনিয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না শর্তে স্থানীয় এলাকার ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ ব্যক্তি বলেন, দু’টি পুকুরই ছিলো শতবর্ষী। ভরাটের সময় স্থানীয়দের অনেকে এতে বাধা দিয়েছিলো। কিন্তু প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এখানে ভরাট, দোকানপাট ও বাড়ি সবই নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে অবস্থাটা এমন হয়েছে যে এলাকায় আগুন লাগলে নেভানোর জন্য একটু পানি পাওয়া যাবে না।

প্রায় এক দশক আগে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের পাশেই শহীদ সামছুল হক সড়কে ওয়াপদা অফিস এলাকায় প্রয়াত হাফিজ উদ্দিনের পরিবারের সদস্য বিশাল আকৃতির পুকুর ভরাট করেছেন। সেখানে এরই মধ্যে দু’টি বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে ১৩ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণের কাজ চলছে ওই এলাকায়। নির্মাণাধীন এই ভবনের অর্ধেক পড়েছে পুকুরের ভেতরে।

কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, এক সময় কুমিল্লায় মানুষ ছিলো কম। তবে প্রতিটি বাড়ির সামনেই পুকুর ছিলো। কোন কোন বাড়িতে দুইটা পুকুরও ছিলো। আমাদের বাসা নগরীর বজ্রপুরে; আমার জন্মের পর এই এলাকায় ৭ থেকে ৮টি পুকুর দেখেছি। যেগুলোর এখন অস্তিত্ব নেই; পুকুরের জায়গায় উঠেছে বহুতল ভবন। কুমিল্লায় আগে অনেক দিঘিও ছিলো। এর মধ্যে কয়েকটি দিঘিও ভরাট হয়ে গেছে। যেমন স্বাধীনতার পরে কুমিল্লা শাসনগাছা এলাকার ডাকবাংলো দিঘি এবং পাকিস্তান আমলে ইপিজেড সড়কের আনন্দ সাগর দিঘিও ভরাট হয়ে গেছে। এখনো কয়েকটি দিঘি যা-ই টিকে আছে, কিন্তু পুকুরগুলো নাই হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিগত সময়ে একের পর এক পুকুর ভরাট করেছে। সাম্প্রতিক বছরে জেলখানা কর্তৃপক্ষ দু’টি পুকুর ভরাট ছাড়াও বিশাল একটি জলাশয় ভরাট করে ১৪ তলার কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। এছাড়া পুলিশ, সড়ক ও জনপথ বিভাগও পুকুর ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে। আমরা প্রতিবাদ করেও একটি ভরাট রুখতে পারিনি। পুকুরের শহর কুমিল্লায় এখন পুকুরের অস্তিত্ব টিকে থাকাই দায়।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), কুমিল্লার সাবেক সভাপতি আলী আকবর মাসুম বলেন, কুমিল্লার কোন সরকারি দপ্তরেই পুকুরের সংখ্যার তথ্য নেই। তবে আমাদের তথ্যমতে ২০০০ সালের আগেও কুমিল্লা শহর এলাকায় ৫ শতাধিক পুকুর ছিলো। বর্তমানে এই সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ দুইশো। বর্তমানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে বাকি পুকুরগুলো রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। বিগত সময়ে প্রতিটি ঘটনায় ব্যবস্থা নিলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান পুকুর ভরাট করায় মানুষ ভরাটে আরো উৎসাহী হচ্ছে।

এদিকে, কুমিল্লা নগরীতে পুকুর ভরাট করায় গত বছরে চারটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লা কার্যালয়। ২০১১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লা কার্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। অবাক করা ব্যাপার হলো- ২০২৩ সাল ছাড়া এই দীর্ঘ সময়ে কুমিল্লা নগরীর ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র একটি মামলা হয়েছে। তবে বেশ কয়েকজনকে নোটিশ দিয়ে ডেকে এনে পুকুর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার শর্তে জরিমানা আদায় এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যেমে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু একটি পুকুরও পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসে মোহাম্মদ রাজীব বলেন, প্রাচীনকাল থেকে কুমিল্লা পুকুর ও দিঘির শহর। আমরা কুমিল্লার ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করছি। কোথায় পুকুর, ডোবা ও জলাশয় ভরাটের তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। ২০২৩ সালেই ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে ৪টি। আর সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান ভরাটের কাজ করেছেন- তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। জলাশয় ও পুকুর ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো.ছামছুল আলম বলেন, পুকুর ভরাট রুখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এসব বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।
পুকুরের ওপর কীভাবে বহুতল ভবনের অনুমুতি দিল সিটি করপোরেশন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি গত বছরের শেষ সময়ে এখানে যোগদান করেছি। আমার যোগদানের পর এমন ঘটনা ঘটেনি। অতীতে হয়ে থাকলে বেআইনীভাবে অনুমুতি দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই অন্যায়।

এ প্রসঙ্গে জানতে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, আমাদের দপ্তরে সরকারি পুকুরগুলোর তালিকা আছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুরের বিষয়ে কোন তথ্য নেই। আমার দায়িত্বে সময়ে দেখেছি- কুমিল্লা নগরীতে দেড়/দুই বছরের মধ্যে একটি পুকুরও ভরাট হয়নি। আমরা এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছি। কোথাও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কেউ পুকুর বা জলাশয় ভরাটের চেষ্টা করলে আমরা আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেব।