শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement
  • প্রচ্ছদ » sub lead 3 » সোমবারের সময়ের কড়চা : কান্দিরপাড়ে পুলিশের মোবাইল ছিনতাই ও তিনটি শোক-আমার অসুখ


সোমবারের সময়ের কড়চা : কান্দিরপাড়ে পুলিশের মোবাইল ছিনতাই ও তিনটি শোক-আমার অসুখ


আমাদের কুমিল্লা .কম :
12.09.2022

শাহাজাদা এমরান ।।

১. গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় যাওয়ার আগে ভাবলাম একটু ফেসবুকে চোখ বুলাই। ফেসবুক অন করতেই চোখে পড়ল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুল ইসলাম সাহেবের একটি স্ট্যাটাস। একজন সজ্জন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নগর কুমিল্লায় তিনি অধিক পরিচিত। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের যে উর্ধ্বগতি গিয়েছে বিশেষ করে ডিম যখন ট্রিপল সেঞ্চুরি করে ফোর্থ সেঞ্চুরি করার পথে অগ্রসরমান ছিল, তখন তার নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত নগর কুমিল্লায় তাৎক্ষণিক কিছুটা হলেও লাগাম টানতে সহায়তা করেছিল। যা কুমিল্লার নগরবাসীর কাছে ছিল প্রশংসনীয়। আমার আলোচনার আগে সেই আসাদুল ইসলাম সাহেবের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পাঠকদের সুবিধার্থে হুবহু নিচে তুলে ধরলাম। তিনি লিখেছেন,
‘‘ কান্দিরপাড়ে মোবাইল ছিনতাই অত:পর…আজ (৭ সেপ্টেম্বর) দাপ্তরিক কাজে টিমসহ কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকার আশেপাশে ছিলাম। এক পর্যায়ে বেলা বারোটার দিকে আমরা পূবালী চত্বর হয়ে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম। ঠিক পুলিশ বক্সটির সামনে আসা মাত্রই আমাদের টিমে গাড়ির সামনে বসে থাকা একজন পুলিশ সদস্য চিৎকার করে ওঠেন। কী হলো? জানতেই বললেন স্যার মোবাইল নিয়েছে! বলেই গাড়ি থেকে
নেমে জাপটে ধরলেন ছিনতাইকারীকে। তিনি দেখেন, সাদা পোশাকে থাকা একজন পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে সাদা শার্ট পরিহিত এক যুবক নীরবে-নি:শব্দে পকেট থেকে মোবাইল তুলে নিচ্ছেন। যার কাছ থেকে নিলেন তিনি বুঝতেও পারলেন না! মোবাইলসহ ছিনতাইকারীকে ধরে তার কাছে নেওয়ার পর পকেটে হাত দিয়ে দেখেন মোবাইল নাই। পরে আমাদের ব্যস্ততা থাকায় ছিনতাইকারীকে কান্দিরপাড়ে দায়িত্বরত পুলিশ
সদস্যদের হেফাজতে রেখে চলে আসি। তাকে দেখে পেশাদার মনে হয়েছে। দিনে দুপুরে কান্দিরপাড় এলাকার মতো ব্যস্ততম রাস্তায় ছিনতাই হচ্ছে। সবার সতর্ক হওয়া উচিত।’’
কুমিল্লা নগরীতে অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় চুরি-ছিনতাই যে বেড়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুল ইসলাম সাহেবের এই একটি স্ট্যাটাসই হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
কুমিল্লা নগরীর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে যদি দিনে দুপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ির সামনে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যই ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন তাহলে নগরীর সার্বিক অবস্থা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে প্রতিনিয়তই চুরি ছিনতাই হচ্ছে। যার অধিকাংশই গণমাধ্যমে আসে না। উঠতি বয়সের ছেলেদের রাত বিরাতের আড্ডা এখনো নগরীতে দৃশ্যমান। নবাগত পুলিশ সুপার মহোদয়ের সাংবাদিকদের সাথে পরিচয় পর্ব অনুষ্ঠানে এই বিষয়টি সংবাদকর্মীরা জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছিল। কিন্ত এই পর্যন্ত আমরা দৃশ্যমান কার্যকর অগ্রগতির কোন আলামত দেখছি না। মনে রাখতে হবে, বড় অন্যায় রুখতে হলে আগে ছোট অন্যায় দমন করতে হবে। খুলনায় এরশাদ শিকদার কিন্তু এক দিনেই এরশাদ শিকদার হয়নি। প্রথমেই যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার ছিঁচকে চুরি-ছিনতাই কঠোর হস্তে দমন করত, তাহলে এরশাদ শিকদার কখনো খুলনার অপরাধ জগতের কিং হতে পারত না ।
সুতরাং, কুমিল্লার পুুলিশ প্রশাসনকে বলব, যেকোনো মূল্যে নগরবাসী এবং নগরীতে আসা জনগণকে নিরাপদে চলাচল করার সুযোগ দিন। এক সময় কুমিল্লা নগরীর ছিনতাইকারীদের ডন ছিল জিরা সুমন। এক জিরা সুমন ক্রস ফায়ারে যাওয়ার পর দীর্ঘ দিন নগরীতে অন্য অপরাধ সংগঠিত হলেও চুরি ছিনতাই কিছুটা কমে আসছিল। কিন্তু আজ কয়েক বছর ধরে আবার তা ফিরে আসছে। নগরীকে চুরি ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এখনই কঠোরতার কোন বিকল্প নেই।
২ . গেল সপ্তাহে আমাদের দেশে দুইজন প্রথিতযশা ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিকভাবে একজন মারা যান।
এর মধ্যে দেশের দুই জন হলেন, মহান মুক্তিযুদের অন্যতম সংগঠক,জয় বাংলা , বাংলার জয় এর রূপকার , যিনি জীবদ্দশায় ২০ হাজার গান লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।, এমনকি বিবিসির জরিপে শতাব্দীর সেরা যে ২০ টি বাংলা গান নির্বাচিত হয়েছিল তার মধ্যে তিনটিই ছিল যার তিনি হলেন বিশিষ্ট গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। কুমিল্লার ধুলি মাটিতেই যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তিনি গত ৪ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান।
অপরজন, ড. আকবর আলী খান। তিনি মারা যান গত ৮ সেপ্টেম্বর। কোন বিশেষণে তাকে পরিচিত করব সেই যোগ্যতা যে আমার নেই বা আদৌ যে হবে না এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। তবে এতটুকু বলতে পারি, তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারি আমলাদের মধ্যে যে কয়েকজন প্রথম ভাগে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে শুধু অংশই নেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হবিগঞ্জের এসডিও অফিস খুলে দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে ভারতে গিয়ে প্রবাসী সরকারের সাথে কাজ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বড় নিয়ামক ভূমিকা নিয়েছিলেন, ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক,অর্থনীতিবিদ,লেখক, সচিব,সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংকসহ দেশি বিদেশি নানা পর্যায়ে। তার অসংখ্য বই দেশের অর্থনীতি ও সমাজ নীতি উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে সমাদৃত । জীবনের শেষ পর্যায়ের দিকে তিনি হয়ে উঠছেন বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জাতির কণ্ঠস্বর।
গত ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্য দীর্ঘ দুইশ বছর আমাদের গোলামির জিঞ্জির পরিয়ে রাখলেও তার রানির মৃত্যুতে কিন্তু আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে এক দিন নয় , দুই দিন নয়, তিন তিন দিন শোক জানাতে কৃপণতা করিনি। করবই বা কেন? বাঙালি জাতি তো আর অতটা অকৃতজ্ঞ নয়। বর্তমান বিশ্বের সামগ্রিক রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সমিষ্টিগত পরিস্থিতির বিবেচনায় রানির প্রতি এই শোক আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ জানাতেই পারে। শুধু আওয়ামী লীগ নয় , বিএনপি হলেও হয়তো একই কাজ করত। এই বিষয়ে আমার আপত্তি নেই। কারণ, পরিবারের কর্তা ব্যক্তি ভালো জানবেন, কাকে তেল দিলে আমাদের পরিবারের লাভ হবে।
কিন্তু একটি বিষয় আমি হলফ করে বলতে পারি , ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হয়নি, এমনকি লাভও হয়নি। কিন্তু ড. আকবর আলী খান আর গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুতে জাতি হিসেবে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আগামী কত শত বছরে একজন আকবর আলী খান কিংবা একজন মাজহারুল আনোয়ার জাতি পাবে তা ভবিষ্যতেই ভালো বলে দিবে। আমরা কি পারতাম না এই দুই বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রয়াণে তিন দিন , এমন কি তিন ঘণ্টাও নয়, মাত্র এক ঘণ্টার জন্যও শোক জানাতে? জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে কালো পতাকা উত্তোলন করতে?
ড. আকবর আলী খান এবং গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার দুই জনই রাষ্ট্র কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন জীবিত অবস্থায় যার যার অবদানের কারণে। এই দিক দিয়ে সরকার তাঁদের মূল্যায়ন করেছেন, আমরা কৃতজ্ঞ। আমার কথা হলো, ব্রিটেনের রানির জন্য যদি রাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার কারণে তিন দিনের শোক জানাতে হয় , তাহলে দেশের দুই কীর্তিমান সূর্য সন্তানের শেষ যাত্রায় কেন পুরো জাতি এক সাথে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শোক জানাতে পারবে না?
৩. গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে অফিসের কাজ শেষ করে এপেক্স ক্লাব অব কুমিল্লার সভাপতি এপে. এড. মোহাম্মদ আলী টিপুর জন্মদিন পালন করার জন্য তার বাসায় যাই। যেতে যেতেই শরীরে কিছুটা জ্বর অনুভব করি। অনুষ্ঠান শেষ করে যতটা সম্ভব দ্রুতই বাসায় চলে আসি। রাত ১২টার পর প্রচণ্ড জ্বর আসে। সাথে জ্বরের সাথে মিতালি করা শুরু করে পেটের ওপর ও বুকের নিচে চিন চিন করে ব্যথা। গত দুই দিন ধরেই অবশ্য সন্ধ্যার পর হালকা জ্বর আসতো। নাপা খেলেই সহানুভূতি দেখিয়ে চলে যেত জ্বর। তাই এই জ্বর নিয়েও অতটা আমলে নেইনি। এবারো ভাবছি ডাবল নাপা খেলে চলে যাবে। কিন্তু জীবন বন্ধুর লাল নোটিশে কিছুটা ভড়কে যাই। কারণ,আমাকে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে । কেন বার বার জ্বর আসে তা তার জানতে হবে। ডাক্তারের কাছে না গেলে বাসায় রান্নায় বান্না বন্ধ। কি আর করা । সহকর্মী তরুণকে ফোন করে জীবন বন্ধুকে নিয়ে সিডিপ্যাথ হসপিটালে গেলাম পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে। মনে মনে ভাবছি , ডাক্তার দেখেই বলবেন ভাইরাস জ্বর।দুই একটা নাপা টাপা লিখেই শেষ করে দিবেন। কিন্তু মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিন ভাইকে দেখালাম। যত্ন করে দেখলেন। দেখে ৭টি পরীক্ষা দিলেন। ৫টি করালাম। পরীক্ষায় টাইফয়েড জ্বরসহ বিভিন্ন সমস্যা ধরা পড়ল। ছল ছল করে উঠল জীবন বন্ধুর চোখ। ডাক্তার দিলেন হাসপাতালে ভর্তি। বললাম, আমার বাসার কাছে আরেকটি হাসপাতাল আছে। নার্স ডাকলেই চলে আসবে। ইনকেজশন দিতে সমস্যা হবে না। আমার তীব্র আপত্তিতে ভর্তি ক্যানসেল করে ডাক্তার সাহেব টানা দশ দিন রেস্ট দিলেন। অসুখরে বললাম, বাবারে, দশ দিন তোরে নিয়ে আমি বাসায় থাকলে তো আমার জীবন চলবে না , মাফ কর।
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গটি এ জন্য লেখার শেষ অংশে আনলাম যে, এই দুই দিনের দুনিয়ার জন্য আমরা কি না করি। রাত ১১টায় যে আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরি পরদিন সেই আমি হাসপাতালে ভর্তি। মহান আল্লাহ আমাদের কখন কি করেন একমাত্র তিনিই ভালো জানেন । সুতরাং , এই নশ্বর পৃথিবীতে আসলে আমি এবং আমার বলতে কিছুই নেই। আমরা দুই দিনের মেহমান মাত্র। আসুন, আমরা জীবনে যা-ই করি না কেন, পরকালকে যেন ভুলে না যাই। শেষ যাত্রার প্রস্তুুতিটা যেন আমাদের সবার মধ্যেই থাকে এটাই মহান রবের কাছে আমার এবং আমাদের কামনা হওয়া উচিত।
লেখক : সাংবাদিক , সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।