বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর স্মৃতিচারণ
শাহাজাদা এমরান।।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। বাবাসহ সবাই তাকে মুজিব ভাই বলে ডাকতেন। একদিন দুপুরে আমাদের বাসায় কয়েকজন নেতাকর্মী নিয়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু। উঠানে এসেই বড় করে ডাকতে শুরু করলেন আহমেদ আহমেদ বলে। বাবা আগেই জানতেন তিনি আসবেন। সেই মতে মা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কই মাছের তরকারিসহ রান্নাবান্না করে রেখেছেন। আমি তখন থ্রি কি ফোরে পড়ি। এখনকার মতো তখন আমাদের বিল্ডিং ছিল না। দোচালা একটা টিনের ঘর ছিল। বাবা বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের ঘরে বসিয়ে খাবারের আয়োজন শুরু করলেন। আমরা ছোটরা লবণদানি, গ্লাস,জগ,পানি ছোট ছোট জিনিসগুলো এগিয়ে দিতাম । বঙ্গবন্ধু খাওয়া শুরু করেছেন। এমন সময় লক্ষ করলেন তার বাম দিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমাকে হাত ধরে তার সাথে বসিয়ে জানতে চাইলেন, নাম কি? আমি বললাম পারভীন। বললেন, বাবার নাম কি ? বাবা সাথেই ছিলেন। বাবাকে দেখিয়ে হাসি দিয়ে বললাম, অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী। তখন তিনি আমাকে তার প্লেট থেকে কয়েক লুকমা ভাত নিজ হাতে খাওইয়া দিলেন। সেই ভাত খাওয়ার স্মৃতি আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে স্মৃতিচারণ করতে বললে এই কথা বলেই আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলেন বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক,মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রয়াত অ্যাডভোকেট আহমেদ আলীর তৃতীয় কন্যা পারভীন আহমেদ। কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক অভিবাদন সম্পাদক আবুল হাসানাত বাবুলের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তিনি এখন পারভীন হাসানাত নামেই সমধিক পরিচিত। বর্তমানে তিনি সাপ্তাহিক অভিবাদনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
পারভীন হাসানাত। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর অ্যাডভোকেট আহমেদ আলীর ৫ মেয়ে ও ৪ ছেলের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ১৯৬১ সালের ১৪ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁওয়ে। রাজনৈতিক বাবার সন্তান পারভীন হাসানাত জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেন তাদের বাসায় বিভিন্ন বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের আগমন। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে স্মৃচিচারণ করতে বললে অ্যাড. আহমেদ আলীর কন্যা পারভীন হাসানাত বলেন, সে সময় আমি খুব ছোট ছিলাম। তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তাম। বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট অঞ্চলে সফরে যাওয়া এবং আসার সময় প্রায়ই রাত্রিযাপন করতেন কুমিল্লার আমাদের বাসায়। বাবার মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম শুনে তাকে দেখার জন্য সব সময়ই উদগ্রীব থাকতাম। একদিন মুরাদনগরে খুব বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে অসংখ্য মানুষ হতাহত হলো এবং শত শত বাড়ি ঘর ধসে গেল। সারাদেশ ব্যাপী আলোড়ন হলো মুরাদনগরের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে। দুর্গত মানুষদের দেখতে বঙ্গবন্ধু একদিন দুপুরে আমাদের বাসায় এলেন। উদ্দেশ্যে, দুপুরে ভাত খেয়ে বাবাকে নিয়ে মুরাদনগরে যাবেন। উঠানে এসেই আহমেদ আহমেদ বলে ডাকতে শুরু করলেন। তিনি আমার মাকে ছোট বোনের মতো দেখতেন। পরে ঘরে গিয়ে মাকে বললেন, হোসনেআরা বেশি কিছু দরকার নেই। যা আছে তাই দিয়ে তাড়াতাড়ি ভাত দাও। মুরাদনগর সফর করে সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকা ফিরতে হবে। ঢাকায় পার্টির মিটিং আছে। এরপর ভাত খাওয়ার সময় আমি তার বামে দাঁড়িয়ে ছিলাম। খাওয়ার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে নাম, বাবার নাম জিজ্ঞেস করে কয়েক লোকমা ভাত নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিলেন, যা আমার সারাজীবন মনে থাকবে।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আরো কয়েকটি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পারভীন হাসানাত বলেন, বঙ্গবন্ধু যেদিন আমাদের বাসায় রাত্রিযাপন করার উদ্দেশ্যে আসতেন, তার আগে তিনি বাবাকে ২০৯৮ এই নম্বরে ফোন করে দিতেন। একদিন বঙ্গবন্ধু আসবেন শুনে আমি, মেজ আপা নাছরিন ফেরদৌসীসহ আমরা পাড়ার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা প্রস্তুত হলাম তিনি আসা মাত্রই আমরা স্লোগান দিব। যে কথা সে কাজ। মেজ আপা খুব জোরে স্লোগান দিতে পারতেন। যেই না বঙ্গবন্ধু আমাদের বাসার সামনে এলেন, সাথে সাথে মেজ আপা স্লোগান দিলেন মুজিব ভাইয়ের আগমন, আমরা বললাম শুভেচ্ছা স্বাগতম। এই স্লোগান শুনে সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু মেজ আপাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, আমি তোর বাবারও ভাই,মায়েরও ভাই আবার তোরও ভাই! কেন মুজিব মামা বলা যায় না। সে থেকে বঙ্গবন্ধু যতবার আমাদের বাসায় এসেছেন কিংবা স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় দেখেছি ততবারই তাকে মুজিব মামা বলে ডেকেছি। মামা বলে ডাক দিলে তিনি খুব খুশি হতেন।
আরেকটি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পারভীন হাসানাত বলেন, একদিন আমাদের এলাকার সবাই বাবাকে এসে ধরলেন, তারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চান। এবার বঙ্গবন্ধু যখন আসবেন বাবা যেন সেই ব্যবস্থা করে দেন। পাড়ার নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক কাজগুলো করলেন। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন এই কথা বলে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা হলো। সবাই এলেন। বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ভাষণ দিয়ে যখন চলে গেলেন, তখন আমাদের পাড়ার ঝানুর মা নামে একজন কাজের মহিলা ছিলেন। তিনি বললেন,কই, বঙ্গবন্ধু না আমাদের বাসন (প্লেট) দিবেন। হেই জন্য তো কাম ফালাইয়া আইছিলাম। অহন দি দেখি কতা(কথা) কইয়া গেলগা। ঝানুর মার এই কথা শুনে সবার মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। আসলে বিষয়টা হলো, ঝানুর মাকে বলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন আপনাদের উদ্দেশ্যে,আপনারা আসবেন। যেহেতু তিনি পড়াশোনা একেবারেই জানেন না, তাই তিনি ভাষণকে মনে করছেন থালা বাসন(প্লেট) দিবেন।