আজ ২৪ এপ্রিল। সাভারের রানা প্লাজা ধসের চার বছর পূর্তি। ২০১৩ সালের এই দিনে সকালে কাজে যোগ দিতে গিয়ে ভবন ধসে প্রাণ হারায় সহস্রাধিক শ্রমিক। চাপা পড়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে হাজারো শ্রমিক। হাত-পা হারিয়ে জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করা আহত ব্যক্তিদের এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতি। এছাড়া সেদিনের ঘটনায় নিখোঁজ অনেকের স্বজনরা এখনো খুঁজে বেড়ায় তাদের প্রিয়জনদের। প্রিয়জন হারানোর বেদনা এখনো বুকে ধরে আছে স্বজনহারা মানুষ।
প্রতি বছর এই দিনটি আসার আগে বিধ্বস্ত রানা প্লাজার সামনে জড়ো হয় প্রিয়জনের শোকে কাতর অনেকেই। অপলক নয়নে শূন্যের দিকে চেয়ে থেকে অনেকে খুঁজে বেড়ান নিখোঁজ প্রিয়জনকে। আবার অনেকে স্বজন হারানোর স্থানটিতে এসে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন। চলে যাওয়া প্রিয় মানুষটির স্মৃতি মনে পড়ে অনেকের চোখ বেয়ে আসে অশ্রুধারা।
রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান একটি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র অপারেটর রিনা আক্তার। ট্রাজেডির চার বছর পূর্তির দিকে ধসে পড়া ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তার মা বাসনা বেগম। উপার্জনক্ষম মেয়ের মৃত্যুতে তিনি এখনো শোকাহত।
সন্তানহারা মধ্যবয়সী বাসনা বেগম জানালেন, সন্তান হারানোর এই জায়গাটিতে তিনি প্রতিবছর এসে সন্তানকে স্মরণ করেন। তার কাছ থেকে জানা যায়, ঘটনার চার বছর পার হওয়ায় পরিবারের অনেকে স্বাভাবিক হলেও এখনো মেয়ের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে আসে। মেয়ে হারানোর কষ্ট এখনো তাকে তাড়া করে। বলার সঙ্গে সঙ্গে তার দুচোখ ভরে নেমে আসে অশ্রুধারা।
আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বাসনা বেগম ঢাকাটাইমসকে জানান, তার বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া থানাধীন পাটগাতি গ্রামে। ঢাকায় এসে তার দুই মেয়ে রিনা ও রূপা রানা প্লাজায় কাজ নেন। দুর্ঘটনার দিন তার বড় মেয়ে রিনা প্রাণ হারান। শরীর খারাপ হওয়ায় সেদিন কাজে যায়নি ছোট মেয়ে রূপা। তাই প্রাণে বেঁচে যায় সে। ঘটনার একদিন পর সাভার অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠ থেকে মেয়ের লাশ নিয়ে দাফন করা হয়। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যও পেয়েছেন। কিন্তু এত দিনেও ভুলতে পারেননি মেয়ের কথা। তাই শুধু এই দিনে নয় সময় পেলেই এখানে আসেন তিনি।
তিনি বলেন, মেয়েকে হারিয়ে সংসারের টানাপোড়নের জন্য এখন মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হয় তাকে। পরিবার নিয়ে থাকেন আশুলিয়ার নিরিবিলি এলাকার মুক্তাধারা হাউজিংয়ে।
বিধ্বস্ত রানা প্লাজার সামনে দেখা মেলে মধ্যবয়সী বেলেদা খাতুন নামে অপর এক নারীর। রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় নিটওয়্যার বটোম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় তলায় ঝাড়–দারের কাজ করত বেলেদা। বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার তাজনগর গ্রামে।
বেলেদা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ওই দিন কাজে যেতে মন চাইছিলো না তার। তারপরও গিয়েছিলেন পেটের তাগিদে। না হলে তো চাকরি থাকবে না। সকাল নয়টার দিকে বিকট শব্দে আচমকা চারপাশ অন্ধাকার হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এরপর দুপুর দুইটার দিকে তাকে উদ্ধার করা হয়। পরে তার ভাতিজি তাকে সেখান থেকে বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই সময় শরীরের বাম অংশে আঘাত পেয়েছিলেন তিনি। এরপর সিরআরপি ও অ্যাকশন এইডের সহযোগিতায় তার চিকিৎসাসেবা চলে এক বছর। এরপর শারীরিক ও মানষিক যন্ত্রণা থাকলে অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করানো হয়নি তার।
সেদিনের ঘটনায় নিখোঁজ সন্তান ফারজানার খোঁজ এখনো পাননি নূর নাহার খাতুন নামে এক সন্তানহারা মা। পাবনার আতাইকুলার এই নারী সন্তানের খোঁজে এখনো অপেক্ষা করছেন।
মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে নূর নাহার কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার এমন ভাগ্য যে আমি মেয়ের লাশটিও পাইনি। এতবড় হতভাগা মা আমি।’ তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণের জন্য টাকা পেলেও সন্তান হারানোর শোক তাকে প্রতিনিয়ত নাড়া দেয়। কেউ যদি হঠাৎ এসে বলে আপনার সন্তানের সন্ধান মিলেছে, এমন আশায় তিনি এখনো মেয়ের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন।