বুধবার ১ †g ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


যেভাবে গড়ে উঠলো চা বিক্রেতার স্বপ্নের স্কুল!


আমাদের কুমিল্লা .কম :
05.11.2019

মাহফুজ নান্টু। কুমিল্লা বরুড়া উপজেলার নলুয়া চাঁদপুর এলাকার মো:মাক্কু মিয়ার ছেলে চা দোকানী মো:আবদুল খালেক। স্বাধীনতার পূর্বে তার চা দোকানের পাশেই বহু কষ্টে ত্রিশ শতাংশ জমি কিনেছেন। চা দোকানের স্বল্প আয়ে কোন রকম সংসার চালাতেন। নব্বই দশকের শেষের দিকের ঘটনা। চা-দোকানী আবদুল খালেক এক রাতে তার দুই ভাতিজাকে বললেন তিনি একটি স্কুল নির্মাণ করতে চান। ভাতিজারা জানালো স্কুল করতে জমি পাবেন কোথায়। প্রতি উত্তরে স্বপ্ন জাগানিয়া চাচা মো:আবদুল খালেক বললেন রাস্তার পাশে আমার যে জমিটুকু আছে তাতে স্কুল নির্মাণ করা হবে। কথাটি ওই রাতেই গ্রামবাসীর কাছে পৌঁছে যায়। সকালে গ্রামবাসী সহোৎসাহে স্কুল নির্মাণের জন্য কোদাল খন্তা নিয়ে হাজির। নিজের এত মূল্যবান জমিটুকু স্কুলের জন্য বিনামূল্য দিয়ে দেয়ায় পরিবার পরিজন বহু কটু কথা বলেছেন। তবুও স্কুল নির্মাণে পিছু পা হননি স্বপ্ন জাগানিয়া মানুষ মো:আবদুল খালেক। পরে দিয়েছেন আরো ২৪শতক।
১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি কাঠ-টিন বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মিত নলুয়া-চাঁদপুর হাই স্কুলটি পাঁচজন শিক্ষক ও দেড়শ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে প্রায় ২২ বছর পর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে অর্থ্যাৎ গত মাসে স্কুলটি এমপিওর তালিকাভুক্ত হয়। এমপিওর খবরটি চা দোকানী আবদুল খালেকের কানে পৌছালে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। বয়সের ভারে নূহ্য মো:আবদুল খালেক লাঠি ভর দিয়ে স্কুলের মাঠে বিচরণ করেন। সম্ভবত তিনি অতীত স্মৃতিচারণ করছিলেন। জরাজীর্ণ স্কুলটিতে এখন দুটি দালান নির্মাণ করা হবে। অবকাঠামোগত আর কোন অসুবিধা হবে না। এলাকাবাসীর আশা অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি পেলে ১৪ নং ল²ীপুরের ইউনিয়নের অন্তত নলুয়া-চাঁদপুরসহ অন্তত কুড়িটি গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভালো ভাবে লেখাপড়া করতে পারবে।
স্কুলটির সিনিয়র শিক্ষক শাহ আলম ও বিষ্ণু কুমার লোধ জানান, অত্র এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মো:আবদুল খালেকের স্বপ্নটি এলাকাবাসীও যেভাবে নিজের মত করে নিয়েছে তাতেই স্কুলটি এতদূর আসতে পেরেছে। সবার সার্বিক সহযোগিতায় স্কুলটি ফলাফলেও ভালো করছে। সর্বশেষ গত এসএসসি পরীক্ষায় তারা শতভাগ পাশ করেছে।
এলাকাবাসী জানান, ১৪ নং ল²ীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো:আনোয়ারুল ইসলাম মজুমদারের সার্বিক সহযোগিতায় স্কুলটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংগ্রহে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি প্রবাসী আলী আহমেদও একজন শিক্ষানুরাগী। স্কুলটিকে এগিয়ে নিতে তারাও বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এমপিও হওয়ার পর এলাকাবাসীর দাবি স্কুলটি মো:আবদুল খালেকের নামে যেন নামকরণ করা হয়। কারণ স্কুলটির জন্য সর্বপ্রথম তিনিই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। স্কুলটির জন্য নিজের জীবনের একমাত্র জমিটিও দান করেছেন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো:রফিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকতা জীবনে মো:আবদুল খালেকের মত শিক্ষা অন্ত:প্রাণ একজন মানুষ আমি আর দেখি নাই। এছাড়া এখানের যারা রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যক্তিবর্গসহ আপামর সাধারণ মানুষ রয়েছেন তারাও শিক্ষানুরাগী। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্কুলটি নির্মাণ,স্কুলটির এমপিও হওয়া এবং ভবিষ্যতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছি।
এদিকে গতকাল সোমবার সংবাদকর্মীদের আসবেন শুনে লাঠি ভর দিয়ে স্কুলে আসেন স্বপ্ন জাগানিয়া মানুষ মো:আবদুল খালেক। চোখেমুখে উচ্ছাস আর আনন্দ। স্কুল নির্মাণ করার নেপথ্যের কথা বললেন। মো:আবদুল খালেক জানান,আবদুর রহিম ও সিরাজুল ইসলাম নামে দু’জন ভাতিজার সাথে পরামর্শ করে স্কুলটি নির্মাণ শুরু করি। আমার ত্রিশ শতাংশ ও পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সাহায্য সহযোগিতায় নব্বই শতাংশ জমিতে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলটি।
স্মৃতির ডায়রী হাতড়িয়ে মো:আবদুল খালেক বলেন,স্বাধীনতার পূর্বে আইয়ুব খানের শাসনামলে আমি বহু কষ্টে আমার চায়ের দোকানের পাশে ত্রিশ শতাংশ জমি রাখি। তখনকার সময় থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এই এলাকার আশি ভাগ মানুষ নিরক্ষর ছিলো। একদিন দোকানে বসে আছি। কেউ একজন আমাকে খালিক্কা বলে ডাকে, রহিম নামে আরেক জনকে রহিম্মা বলেন ডাকে। লেখাপড়া না থাকায় একজন মানুষ আরেকজন মানুষের নাম ব্যঙ্গ করে ডাকে। সেই থেকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখি। মানুষ শিক্ষিত হলে এমন হবে না। এদিকে স্কুলের জন্য জমি দেয়ায় আমার স্ত্রী আমাকে কটু কথা শোনালেন আর আত্মীয়-স্বজনরা পাগল বলে উপহাস করলো। কোটি টাকার জমি আমি স্কুলের নামে বিনামূল্য দিয়ে দিয়েছি এটাই ছিলো তাদের আফসোসের কারণ।
১৯৯৯ সালে ২৮ অক্টোবর আমার স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে আমার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি দেখতে আসলেন। আমি স্কুলের অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। স্কুলে লেখাপড়া ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুগ্ধ হয়ে আমার স্ত্রী আমার কাছে এসে বললো আপনি স্কুলের জন্য জমিটা দিয়ে অনেক মহৎ কাজ করেছেন। আমি জমির মূল্য পেয়ে গেছি। ওই দিন বিকেলে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি যাওয়ায় সময় একটি প্রাইভেটকারের সাথে ধাক্কা লাগে আমার স্ত্রীর। কাপড় পেচিয়ে যায় প্রাইভেটকারের সাথে। পাঁচ কিলোমিটার দূরে পড়ে থাকে আমার স্ত্রীর লাশ। আমার সন্তান নেই। স্কুলটিই আমার স্ত্রী সন্তানের মত। এক কথায় স্কুলটিই আমার পরিবার।