সম্মুখ সমরের মুক্তিযোদ্ধা-২৫
শাহাজাদা এমরান।।
বীরমুক্তিযোদ্ধা এম এ হালিম বলেছেন,৭১ সালে আমি ইপিআরে চাকুরী করি। পোষ্টিং ছিল ঢাকার রাইফেল ট্রেনিং স্কুলে ।৭মার্চ রেইসকোর্সের বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনার জন্য যেতে চাইলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাদের যেতে দেয়নি। মনের ক্ষোভে দু:খে তখন আমাদের শরীর জ্বল জ্বল করছিল। তখন আমরা অফিসে বসে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনি। সেই ভাষন আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্ধুদ্ধ করে।
এম এ হালিম। পিতা মো. আবদুল জব্বার এবং মা হালিমা বেগম। ১৯৫০ সালে ২৫ মে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার ৪নং আমড়াতলী ইউনিয়নের শিমরা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান ৩য়।
কিভাবে যুদ্ধে গেলেন জানতে চাইলে বীরমুক্তিযোদ্ধা এম এ হালিম বলেন,১৯৭১ সালে আমি দশম শ্রেনীর ছাত্র থাকাবস্থায় পাকিস্তান ইপিআরে যোগ দেই। ইপিআরে যোগ দেওয়ার মাত্র দেড় মাসের মাথায় রেইসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষন দেন। আমরা বাঙ্গালী সৈনিকরা যেতে চাইলে আমাদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাদের সেদিন যেতে দেননি। আমরা বাঙ্গালী ১০/১২জন সৈনিক ভাষন শুনছি । ভাষন শুনার এক পর্যায়ে যখন আমরা হাত তালি দিলাম তখন পাকিস্তানী এক সৈনিক নায়েক মোহাম্মদ খান হঠাৎ করে আমাকে লাথি দিয়ে বসে। পরে দেখি আমাকে লাথি দেওয়ার কারণে অন্য বাঙ্গালী ইপিআর সদস্যরা চুপ করে গেল। তখন এই অপমান সহ্য করতে না পেরে ঐদিনই আমি চাকুরী ছেড়ে চলে আসি। দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হলো একদিন পর ২৭ মার্চ ভোর রাতে মা বাবাকে বলে বানাশুয়া দিয়ে গাজীর আইল হয়ে ভারতের সোনামুড়া যাই। সোনামুড়া যাওয়ার পর এক ইপিআর সদস্যের সাথে আমার পরিচয় হয়। নামটি এখন মনে নেই। সেই ইপিআর সদস্য আমাকে ১৩৫ মেলাঘর অফিসে নিয়ে যায়। এর ১০/১৫দিন পর ইপিআর সদস্যদের সাথেই আমি যোগ দেই।তখন আমাদের সেকশন কমান্ডার ছিলেন, ঢাকার হাবিলদার শিরাজ। প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার মোতালেব।
প্রথম যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন,আমার হাতিয়ার ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। আমরা ভারত সীমান্ত থেকে বিবির বাজার এসে যুদ্ধ করে আবার সীমান্ত পাড় হয়ে ওপারে চলে যাই। এই দিনটি ছিল ১৩ এপ্রিল মঙ্গলবার। বিকাল ৪টার দিকে হানাদার বাহিনী আমাদের বাংকারে ৬ পাউন্ডের একটি বোমা নিক্ষেপ করলে আমাদের ৩ জন শহীদ ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে আমরা এর ব্যাপক প্রতিশোধ নেই।এই বিবির বাজার প্রায় দেড়মাস যুদ্ধ করি।
মে মাসের দিকে একটি সম্মুখ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের একটি গুলি আমার ডান পায়ে এলে লাগে। পরে মারাত্মক আহত অবস্থায় আমাকে ব্যানার্জি বাগান হাসপাতালে নেয়া হয়।হাসপাতালে পুরো এক মাস চিকিৎসা নিয়ে বাংকারে যোগ দিয়ে জুলাই পর্যন্ত এখানে দায়িত্ব পালন করি।
আগষ্টে আমি এস এল আর চালানোর প্রশিক্ষন নেই ২১ দিন পালাটোনা প্রশিক্ষন কেন্দ্রে। । প্রশিক্ষক ছিলেন নায়েক আমজাদ হোসেন ও ভারতীয় একজন প্রশিক্ষক। এই প্রশিক্ষন শিবিরে আমার সাথে ছিল আবদুস সালাম,আমজাদসহ ১৮জন। সেপ্টেম্বর মাস থেকে এক মাস ১৫ দিন আমি মেলাঘরে অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করি। পরে আমাকে কোনাবনে পাঠানো হয়। কোনাবনে এক মাস কাজ করার পর দেখি অন্য ইপিআর সদস্যদের আমার সামনে বেতন ভাতা দিচেছ কিন্তু আমাকে দিচ্ছে না। তখন আমি কমান্ডারকে জানালে তিনি বলেন, তুমি তো রিক্রুট ইপিআর,এখনো শপথ নেওনি। একথা শুনে সিদ্ধান্ত নিলাম, না,ইপিআরের সাথে আর যুদ্ধ করব না। ফলে রাগে দু:খে এবং ক্ষোভে ইপিআর ছেড়ে মেলাঘর এসে সৈয়দ মতিউল ইসলাম মন্টুর কোম্পানীতে যোগ দেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কোম্পনীতে থেকেই যুদ্ধ করি।
নভেম্বর মাসের ১২ তারিখ থেকে সোলেমান কমান্ডারের নেতৃত্বে নানুয়া বাজার হয়ে সেনানিবাস এলাকা পর্যন্ত আমরা ৩ দিন রেকি করি। ৮ ডিসেম্বর যখন কুমিল্লা মুক্ত হয় তখন আমরা মেলাঘরে ছিলাম। কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার কথা শুনে সেদিন আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে যে আনন্দ কান্না কেঁদেছিলাম তা ভুলবার নয়। ১০ ডিসেম্বর আমরা ভারতের মেলাঘর থেকে সৈয়দ মতিউল ইসলাম মন্টুর নেতৃত্বে কুমিল্লা আসি। পরে বানাশুয়ায় কমান্ডার সোলেমানের নেতৃত্বে ক্যাম্প স্থাপন করি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই ক্যাম্পে অবস্থান নেই। পরে আমরা সেনানিবাসে গিয়ে অস্ত্র জমা দিয়ে নগদ ৩০০ টাকা, জেনারেল ওসমানীর সার্টিফিকেট ও ১টি কম্বল নিয়ে বাড়ি চলে আসি।
যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরবর্তী জীবন ছিল কোন রকম আর কি।
যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন তা পূরণ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বপ্ন পূরন আগে হয়নি। এখন হচ্ছে।
আগামীর বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান জানতে চাইলে তিনি বলেন,ভাল দেখতে চাই।