মাসুদ আলম
গত শুক্রবার ঢাকা থেকে চাঁদপুরের মতলবগামী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডোবায় পড়ে গেলে যাত্রীদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন দাউদকান্দি হাইওয়ে থানা-পুলিশের কনস্টেবল মোঃ পারভেজ মিয়া। কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গৌরীপুর বাস স্ট্যান্ডের পাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মতলব এক্সপ্রেস নামের বাসটিতে ৫০ জন যাত্রী ছিলেন। বাসের ৫০ জন যাত্রীর মধ্যে ২৫ থেকে ২৬ জনকে কনস্টেবল পারভেজ মিয়া নিজে উদ্ধার করেন। এর মধ্যে ৭ বছরের এক শিশু ছিল।
মোবাইল ফোনের সাক্ষাৎকারে সাহসী কনস্টেবল পারভেজ মিয়া জানান, যাত্রীবাহী বাসটি যখন ৫০ জন যাত্রী নিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডোবায় পড়ে যায়, তখন নিজের মনে একটি অনুভূতি সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা বাঁচার জন্য কতো না আকুতি করছে। এসব কথা চিন্তা করার পর আমি নিজেকে নিজে ভুলে যাই। আমার মাথায় তখন শুধু একটা জিনিসই কাজ করেছে, কিভাবে মানুষগুলো জীবিত উদ্ধার করবো।
তিনি বলেন, ডোবায় বিষাক্ত ময়লা আবর্জনা ও পানিতে নামলে আমি বাঁচবো কিনা? সেটাও চিন্তা করতে পারেনি।
পারভেজ মিয়া আরো বলেন, কোন প্রশংসা কিংবা পুরস্কার পাওয়ার আশায় তখন যাত্রীদের প্রাণ রক্ষায় জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে যাত্রীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসিনি। যখন দেখলাম চোখের সামনে যাত্রীরা ভেতরে আটকা পড়েছে, কীভাবে গাড়ির গ্লাসগুলো ভেঙে ফেলি তখন একটু ব্যথাও পাইনি। এখন অবশ্য বুঝতে পারছি পুরো শরীরেই আমার ব্যথা। এখন প্রচুর ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ডান-বাম দুই হাতই প্রচন্ড ব্যথা করছে। গ্লাসগুলো ভেঙে ফেলার সময় গ্লাসের আঘাতে দুই হাতের একাধিক স্থানে কেটে গেছে। সে স্থানে এখনও ব্যথা করছে।
পারভেজ বলেন, আমার বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার হোসেনদি গ্রামে। আমার বাবা আবুল কাশেম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমরা ২ ভাই ও ২ বোন। ভাইদের মধ্যে আমি বড়। ছোটবেলা থেকেই আমি ও আমার ছোট ভাই গ্রামের ভালো কাজের প্রতি উৎসাহী ছিলাম। ২০০৮ সালে স্থানীয় হোসেনদি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরির পর গত বছর আগষ্ট মাসে চট্টগ্রাম দোহাজারী থানায় যোগ দেন হাইওয়ে পুলিশে। এরপর চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে কুমিল্লা দাউদকান্দি থানায় হাইওয়ে পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
তিনি বলেন, দাউদকান্দিতে আমার চোখের সামনে যখন যাত্রীবাহী একটি বাস খাদে পড়ে যায়, তখন অনেক লোক এগিয়ে এলেও তারা ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু নর্দমা ও বিষাক্ত পানিতে গাড়ির ভেতর আটকে থাকা নারী ও শিশুসহ যাত্রীদের চিৎকার শুনে কেউ যায়নি। আমি তখন মানবিক কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।
তিনি আরো বলেন, গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি অনেকে হাতের ইশারায় সাহায্য চাচ্ছে, তখন গাড়ির গ্লাস ভাঙা শুরু করি। কিন্তু গাড়িটি উল্টে থাকায় ও জানালার গ্লাস বন্ধ থাকায় ঘটনার আকস্মিকতায় অনেক যাত্রীই ভেতর থেকে বের হতে পারছিল না। আমার আশঙ্কা ছিল নর্দমাটিতে বিষাক্ত গ্যাস জমা থাকতে পারে, তাই আমার কোমরে একটি গামছা বেঁধে স্থানীয় এক লোককে গাড়ির কাছে রেখে বলি ভেতর থেকে আমার কোনো সাড়া শব্দ না পেলে আমাকে টেনে তুলবেন। এভাবেই অন্তত ২৫ থেকে ২৬ জন যাত্রীকে উদ্ধার করি।
এ বিষয়ে কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ জানান, যাত্রীদের জীবন বাঁচাতে আমাদের পারভেজ ঝুঁকি নিয়ে যা করেছে তা হাইওয়ে পুলিশ বিভাগের জন্য সত্যই প্রশংসনীয়। পুরস্কার দিয়ে কাজের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবুও এ কাজের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি যাতে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে পান এ ব্যাপারে সুপারিশ করা হবে।
তিনি বলেন, তাঁর সাহসিকতায় হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুর রহমানের পক্ষ থেকেও ৫০ হাজার টাকা, কুমিল্লা রিজিয়ন হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। এছাড়াও দাউদকান্দির কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও পেন্নাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা আক্তার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। এসব ভালো কাজে পুরস্কৃত, সম্মানিত ও প্রশংসা করলে যে কোন মানুষের মধ্যে উৎসাহ বাড়ে এবং ভাল কাজগুলোতে এগিয়ে আসে।