শুক্রবার ৩ †g ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


বাহার-আফজলকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে ‘নৌকা’


আমাদের কুমিল্লা .কম :
04.03.2017

শাহাজাদা এমরান।। নানা মুনির নানা মতে বিভক্ত কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কে কেন্দ্র করে ঘুরে ফিরে শুধু একটাই আওয়াজ আসছে। আর তা হলো, জেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা ও স্থানীয় এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় প্রবীন নেতাদের থেকে শুরু করে সাধারণ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের একটাই বক্তব্য, স্থানীয় এমপি বাহার যদি মনে প্রাণে নৌকার পক্ষে কাজ না করে তাহলে এবারও নৌকার পালে হাওয়া লাগার কোন সম্ভাবনা নেই। গতকাল শুক্রবার দুপুরে জেলা আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে এ কথা জানা গেছে। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইজীবী ও প্রখ্যাত আওয়ামীলীগ নেতা এড. আহমেদ আলী দৈনিক আমাদের কুমিল্লাকে বলেন, নৌকা আমাদের জাতীয় প্রতীক। নৌকার স্বার্থেই আফজল-বাহারের উচিত দ্রুত এক টেবিলে বসে নির্বাচন করা।
বিভিন্ন নেতাকর্মী ও সচেতন মহলের বক্তব্য, কুমিল্লার আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে দুই দিকপাল হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি ও অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট। প্রায় কয়েক দশক ধরে এই দুই নেতার অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত হয়ে আছে দলটি। যে কোন নির্বাচনে বিজয়ের সুযোগ থাকলেও এই দুই প্রভাবশালী নেতার কোন্দলের কারণে ফসল চলে যায় অন্যের ঘরে।
তারা বলেন, এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের রয়েছে কুমিল্লার রাজনীতিতে এক বিশাল শক্ত অবস্থান। তিনি কুমিল্লার পৌরসভার পর পর দুই বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। এর মধ্যে একবার চির প্রতিদ্বন্দ্বী অধ্যক্ষ আফজল খানকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এমপি নির্বাচিত হন আকম বাহা উদ্দিন বাহার। তার রয়েছে একটি বিশাল কর্মী বাহিনী। আফজল-বাহার দ্বন্দ্বে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগে অনেক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। ২০০৮ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে দুই নেতা সাময়িক সময়ের জন্য এক হলেও নির্বাচনের পর আবার তারা পুেরানো বৈরিতা শুরু করে।
অধ্যক্ষ আফজল খান পরিবারের অভিযোগ, গেল নির্বাচনে শুধু মাত্র এমপি বাহারের বিরোধীতার কারণেই কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আফজল খান পরাজিত হন। অপর দিকে, খোদ এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারর অভিযোগ, আফজল খান সাহেব যদি ২০০৮ সালে আমার পক্ষে কাজই করতেন, তাহলে তার গোবিন্দপুর কেন্দ্রে ২০০৮সালে নৌকা কম ভোট পায় কিভাবে। এই ভাবেই চলছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের মধ্যে বাক যুদ্ধ।
অপর দিকে, কুমিল্লা জেলার অন্যতম প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ পরিবারের একটি হচ্ছে আফজল খান পরিবার। এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাসায় কয়েকদিন ছিলেনও বলে তার পরিবার সূত্রে জানা গেছে। তিনি আদর্শ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন, ছাত্র রাজনীতি করতে করতে আজকে বর্ষীয়ান আওয়ামীলীগ নেতায় পরিণত হয়েছেন। ছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম আহ্বায়কসহ নানা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন। তারও রয়েছে সংগঠিত একটি কর্মী বাহিনী।
আসন্ন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমপি বাহার চেয়েছিলেন, তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত , কুমিল্লা জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি , মহানগর আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা আরফানুল হক রিফাত মেয়র পদে মনোনয়ন পাক। এজন্য তিনি যথেষ্ট কাজও করেছেন। মিডিয়ায়ও আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন আরফানুল হক রিফাতই মনোনয়ন পাবেন। কিন্ত সর্বশেষ মনোনয়ন দৌঁড়ে বিজয়ী হন অধ্যক্ষ আফজন কন্যা ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আঞ্জুম সুলতানা সীমা। ফলে স্বাভাবিক কারণেই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। আর এটা আচঁ করতে পেরেই গত ১মার্চ বুধবার কুমিল্লায় এসে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে ম্যারাথন মিটিং করেন কেন্দ্রীয় বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামিম। তিনি পৃথক পৃথক ভাবে মিটিং করেন। মিটিং করেন স্থানীয় এমপি হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সাথেও। কিন্ত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামিমের সামনেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে কেন্দ্রকে জানিয়ে দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের মত এত সহজে কুমিল্লার গ্রুপিংয়ের বরফ গলবে না। কুমিল্লা ক্লাবে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একএম এনামুল হক শামিমের উপস্থিতিতে দ্বন্দ্বে জড়ান হাজী বাহারের অন্যতম অনুসারী ও কুমিল্লা জেলা পরিষদ এর সদস্য আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ ও আফজল খান পুত্র ও মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার ছোট ভাই ডা. নোমান। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে জিএস সহিদ ডা. নোমানকে বলেন, মেয়র না হতেই এ অবস্থা। অপর দিকে, ডা. নোমানও জিএস সহিদকে বলেন, বেশি বাড়বেন না।এই অবস্থায় রাতে কুমিল্লা নগরীর রামঘাটস্থ আওয়ামীলীগের দলীয় কার্যালয়ে সভা করেন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একএম এনামুল হক শামিম। তিনি সকল মহলকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দিয়ে বলেন, নৌকার পক্ষে কাজ না করলে দল করা চলবে না। আর মহানগর কমিটি দেওয়া হবে না এবং পদও দেওয়া হবে না। কিন্ত বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দানের সময় বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে সকল পক্ষ অবস্থান করলেও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে এমপি গ্রুপের কেউ ছিলেন না। তখন থেকেই নগর জুড়ে আলোচনা তাহলে বিভাগীয় সম্পাদক একএম এনামুল হক শামিম কি তাহলে বরফ গলাতে ব্যর্থ হলেন!
এই প্রসঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর আলোচনা ছিল এমপি বাহার গ্রুপ কি নৌকার পক্ষে কাজ করবে না? সাধারণের বক্তব্য, এমপি বাহারের সমর্থন ছাড়া মেয়র পদে আঞ্জুম সুলতানা সীমার পাশ করা কঠিন হবে।
এমপি বাহারকে আস্থায় আনার জন্য কি কাজ করছেন জানতে চাইলে আওয়ামীলীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা ও এমপি বাহারের চির প্রতিদ্বন্দ্বী অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট বলেন, আমি ২০০৮ সালে কষ্ট করে বাহারকে এমপি করেছি। তার প্রতিটি সভা সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে ভোটারদের তার পক্ষে এনেছি। আমার মেয়ে সীমা মনোনয়ন পেয়ে কুমিল্লা এসেই বাহারের সাথে দেখা করেছে। মন্ত্রী লোটাস কামাল , মজিবুল হকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা কথা বলছে, আরো বলবে। আশা করি নৌকার বাইরে যাওয়া সম্ভব হবে না। সে সহ তার লোকেরা নৌকার পক্ষে কাজ করবে।
এ ব্যাপারে কুমিল্লা সদর আসনের এমপি হাজী আকম বাহাউদ্দিন বাহারকে তার সেল ফোনে ফোন দেওয়ার পর তিনি ফোন রিসিভ না করাতে কথা হয় তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত ও মহানগর আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা আরফানুল হক রিফাতের সাথে। তিনি বলেন, আগামী ৬ মার্চ আদর্শ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদের উপ নির্বাচন। সেখানে নৌকা প্রতীকে আমাদের প্রার্থী রয়েছে। আমরা এখন সেখানে ব্যস্ত আছি। আমি ৪০ বছর ধরে আওয়ামীলীগ করি। শুধু মাত্র একবার বাহার ভাইকে বাঁচানোর স্বার্থে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছি। আর কোন দিন নৌকার বাইরে যাই নি। এবারও যাব না। আদর্শ সদর উপজেলার নির্বাচন শেষ হলে আমাদের নেতা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ভাইয়ের সাথে কথা বলে কিভাবে নৌকার পক্ষে কাজ করা যায় আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিব। আমাদের কাছে ব্যক্তি নয়, নৌকাই বড়।
ঢাকায় ওবায়দুল কাদের যা বললেন :
এ দিকে গতকাল শুক্রবার ঢাকায় কুমিল¬া সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের দুই নেতা আফজাল খান ও আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মধ্যে পুরনো দ্বন্দ্ব নিরসন হবে বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে দলের প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীর সঙ্গে দলের নেতা শামীম ওসমানের দ্বন্দ্ব যেভাবে নিরসন হয়েছে সেভাবেই নিরসন হবে কুমিল¬ার দ্বন্দ্ব।
শুক্রবার সকালে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে মহিলা আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। আজ রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে সংগঠনের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

কুমিল¬া সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এবার প্রার্থী করেছে আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন নূর উর রহমান মাহমুদ তানিমও যিনি বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

কুমিল্ল¬ায় ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই আওয়ামীলীগ ভুগেছে বাহার ও আফজালের মধ্যকার বিরোধের কারণে। একাধিক নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য দুই নেতার মধ্যকার দ্বন্দ্বকে দায়ী করা হয়। এবারও আফজাল খানের মেয়ে প্রার্থী হওয়ায় বাহারের অনুসারীরা বিষয়টা কীভাবে নেয় তা নিয়ে কথা উঠেছে এরই মধ্যে। ২০১১ সালের প্রথম মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল আফজাল খানকে। কিন্তু তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কুর কাছে বড় ব্যবধানে হেরে যান। এই পরাজয়ের জন্যও আওয়ামীলীগের বিভেদকে অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়।

তবে ওবায়দুল কাদের মনে করেন এই দ্বন্দ্ব আগামী ৩০ মার্চের ভোটে তেমন প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচনে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কুমিল¬ার মতই তীব্র ছিল? সেটা আমরা মিটিয়ে ফেলেছিলাম। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় দলীয় প্রার্থী (সেলিনা হায়াৎ আইভী) বিজয়ী হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে যেটা সম্ভব, কুমিল¬াতেও সেটা সম্ভব।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জনগণ যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিবে। কিন্তু আমরা আশা করি আমাদের দল ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে লড়বে। আর নির্বাচনে আমাদের দল থেকে ভিন্ন কোন প্রার্থী দেয়া হয়েছে? আওয়ামীলীগ একটি বড় পরিবার। এখানে ভাইয়ে ভাইয়ে ছোটখাটো সমস্যা থাকবেই। নারায়ণগঞ্জে আমরা সমাধান করেছি, কুমিল¬ায়ও সমাধান করবো।’