শনিবার ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
Space Advertisement
Space For advertisement
  • প্রচ্ছদ » লিড নিউজ ১ » – কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল- সর্বত্রই দালাল চক্রের ফাঁদ, সেবা পেতে ভোগান্তির শেষ নেই রোগীদের


– কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল- সর্বত্রই দালাল চক্রের ফাঁদ, সেবা পেতে ভোগান্তির শেষ নেই রোগীদের


আমাদের কুমিল্লা .কম :
11.11.2024

# বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডে দালালদের প্রভাব বেশি
# রোগীদের কৌশলে বেসরকারি ক্লিনিক-হসপিটালে নিয়ে জিম্মি করে টাকা আদায় করা হয়
# এ হাসপাতালে আসা রোগীরা দালাল চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে- পুলিশ
# দালালদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান হচ্ছে, তবে নির্মূল করা সম্ভব না- হাসপাতালের পরিচালক

শামছুল আলম রাজন।।  কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই দালাল চক্রের কারণে। বছরের পর বছর ধরে এ হাসপাতালে আসা সেবা প্রত্যাশীরা দালাল চক্র নিয়ে চরম ভোগান্তিতে থাকলেও দালাল নির্মূলে কর্তৃপক্ষের তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি রোগীদের। বর্তমানে অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, হাসপাতালটির সর্বত্রই ফাঁদ পেতে রেখেছে দালাল চক্র। সেবাপ্রত্যাশীদের ফাঁদে ফেলতে পারলেই ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালটির সর্বত্রই দালালদের দাপট। দালালদের উৎপাতের কারণে সকল উন্নত স্বাস্থ্য সেবা থাকার পরও এ হাসপাতালে সেবা পেতে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডে দালালদের প্রভাব বেশি। কম খরচে উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সেবা দেওয়ার কথা বলে কৌশলে রোগীদের বাগিয়ে নেওয়া হয় বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক-প্যাথলজিতে।

৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। বহির্বিভাগেও ১০ টাকার টিকেটে সেবা নিতে আসেন অন্তত এক হাজার মানুষ। দালাল চক্র সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বহির্বিভাগে বেশি সক্রিয় থাকে, আর অন্যান্য সময় জরুরি বিভাগ ও ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডে।
গত বৃহ¯পতিবার সকাল ১০টার দিকে বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, পুরুষ ও নারীরা আলাদাভাবে ১০ টাকা করে টিকেট কাটতে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওই সময় দুই শতাধিক সেবাপ্রত্যাশীকে লাইনে দেখা গেছে। চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হতেই দালাল চক্র রোগীদের ঘিরে ধরে। এ সময় ব্যবস্থাপত্র দেখে চক্রটি নিশ্চিত হয় রোগীকে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়া হয়েছে কি-না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকলেই রোগীদের বেসরকারি ক্লিনিক-প্যাথলজিতে নিয়ে ফাঁদে ফেলার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন দালালরা। গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগীরা দালালদের ফাঁদে বেশি পড়ছেন বলে জানা গেছে।

হাসপাতালটির বহির্বিভাগের সামনে দায়িত্ব পালন করছেন বেশ কয়েকজন আনসার সদস্য; তাঁদের চোখের সামনেই এসব কাজ করছে দালালরা। আনসারদেরও এ চক্রটির কাছে অসহায় দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক আনসার সদস্য বলেন, এই হাসপাতালে সক্রিয় দালাল চক্রের সংখ্যা দুই শতাধিক। এদের বেশিভাগই স্থানীয়। যার কারণে এদেরকে কিছু বলা যায় না। কিছু বললেই হাসপাতালের গেটের বাইরে নাশতা করতে গেলেও দালালরা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়াসহ হয়রানি করে। অনেক সময় ব্লেড নিয়ে আসে পোচ দেওয়ার জন্য।

ওই আনসার সদস্য আরও বলেন, হাসপাতালটিতে মোট তিন শিফটে কাজ করে দালাল চক্র। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত , বিকেল থেকে রাত ৯টা, ১০টা পর্যন্ত এবং রাত ১০টা থেকে সকাল পর্যন্ত। এসব বিষয় হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্টাফই জানে। কিন্তু দালালরা এতোটাই সংঘবদ্ধ যে তাঁদের হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। আবার হাসপাতালের কিছু কিছু স্টাফও চক্রটির সঙ্গে জড়িত। কোন একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী এলেই চক্রটি চেষ্টা করে রোগীকে বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালে বাগিয়ে নেওয়ার।

জানতে চাইলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের ইনচার্জ সবুজ হোসাইন বলেন, এসব বিষয়তো সবাই জানে। আমাদের চোখের সামনে দালাল চক্র রোগীদের বিরক্ত করলে আমর তাদেরকে বাধা দেই। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যায় না- কারণ চক্রটির প্রায় সকলেই স্থানীয়।

বহির্বিভাগ সেবা নিতে আসা চৌদ্দগ্রামের মুন্সিরহাট এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, রোগীদের ফাঁকে দালালরা এমনভাবে থাকে যে- সহজে তাঁদেরকে চেনা যায় না। দালাল চক্র অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি সক্রিয়। মানুষ অনেক কষ্টে আছে।

মনির হোসেন নামে এক সেবাপ্রত্যাশী বলেন, বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ আর ক্যাজুয়েলিটি ওয়ার্ডই নয়, পুরো হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগেই দালাল চক্র সক্রিয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুধু ”দালাল হতে সাবধান” সাইনবোর্ড টানিয়ে দায় সেরেছে।

বহির্বিভাগ আসা কুমিল্লা নগরের হাউজিং এলাকার বাসিন্দা অন্তঃসত্ত্বা নারী নাসরিন বেগম বলেন, এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। চিকিৎসক আল্ট্রা করতে দিয়েছেন। চিকিৎসক কক্ষ থেকে বের হতেই তিনজন নারী দালাল ঘিরে ধরে বেসরকারি ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য। পরে আমি সরে চলে আসি। পুরুষ ও নারী দালালরা গ্রামের সহজ-সরল মানুষের বেশি ফাঁদে ফেলছে।

কুমিল্লা নগরের টমছমব্রিজ এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে- এমন অভিযোগে জেলার বরুড়া উপজেলার শৈলখালি গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম গত ২৯ অক্টোবর কুমিল্লা কোতায়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই নবজাতকের মৃত্যুর নেপথ্যেও কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দালাল চক্র।

সাইফুল ইসলাম জানান, গত ২১ অক্টোবর রাত ২টার দিকে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তিনি। এ সময় হসপাতালের স্টাফ পরিচয়ে এক দালাল রোগীর সকল কাগজপত্র হাতে নিয়ে তাঁকে বলে মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক টমছমব্রিজ এলাকার একটি হসপিটালে আছেন। এরপর তাঁদেরকে ফাঁদে ফেলে ওই বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় দালাল। এক পর্যায়ে ওই দালাল তাঁদের কাছ থেকে রোগীর বড় ধরণের সমস্যার কথা বলে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে কৌশলে পালিয়ে যান। এরপর শুরু হয় তাঁদের ভোগান্তি। ২২ অক্টোবর ভোরে ৪টার দিকে সিজারের (অস্ত্রোপচার) মাধ্যমে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন তাঁর স্ত্রী। এরপর ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। আরও টাকার জন্য মৃত বাচ্চার পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীকেও আটকে রাখে হসপিটালটি। যদিও সাইফুলের স্ত্রী ফাতেফা বেগমের দাবি, যেই মৃত বাচ্চাটি তাঁদের দেওয়া হয়েছে সেটি তাদের সন্তান নয়। কৌশলে চক্রটি বাচ্চা পাল্টে ফেলেছে।

অভিযোগটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কুমিল্লা কোতায়ালি মডেল থানার কান্দিরপাড় ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মনির হোসেন বলেন, আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি। পাশাপাশি ওই দালালকেও সনাক্তের চেষ্টা করছি। কুমিল্লা জেলার জনসংখ্যা ৬৩ লাখের বেশি। পাশাপাশি চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ আশ-পাশের জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন রোগীরা সেবা নিতে আসেন এই হাসপাতালে। এসব রোগীদের সেবা পেতে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় দালাল চক্র। বলতে গেলে এ হাসপাতালে আসা রোগীরা দালাল চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। প্রায়ই অভিযানে দালালরা ধরা পড়ছেন। তবে দালাল পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়, আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। টম অ্যান্ড জেরি যেমন শুরু হয়েছে কিন্তু শেষ হয় না- তেমননিভাবে দালালরাও শেষ হবে না। আমরা অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে ধরবো- এই কার্যক্রমও একইভাবে চলতে থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো রোগীদের এসব বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।