শনিবার ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
Space Advertisement
Space For advertisement
  • প্রচ্ছদ » লিড নিউজ ১ » কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া সীমান্ত দিনে আসে চিনি, রাতে মাদক, পরিবহন হয় ট্রেনে


কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া সীমান্ত দিনে আসে চিনি, রাতে মাদক, পরিবহন হয় ট্রেনে


আমাদের কুমিল্লা .কম :
24.10.2024

স্টাফ রিপোর্টার ।। কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ভারত সীমান্তঘেঁষা সালদা নদী রেলস্টেশন। স্টেশনের পাশেই ভারতের পাহাড়ি পথ। সেই পথ দিয়ে ভারতীয় চিনিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য চোরাচালান করে স্টেশনে আনা হয়। পরে ট্রেনে সেই পণ্য যায় কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সীমান্তঘেঁষা ওই স্টেশন ঘিরে গড়ে উঠেছে চোরাচালান চক্র। এতে সীমান্তঘেঁষা দুটি গ্রামের শতাধিক লোক জড়িত। দিনের বেলা প্রকাশ্যে চিনি চোরাচালান হলেও মাদকদ্রব্যসহ অন্যান্য পণ্য আসে রাতে।
চোরাকারবারিদের ভাষ্য, পুলিশ, বিজিবিসহ স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি জানে। তাদের ‘ম্যানেজ’ করে চোরাচালানের কাজ চলে। তবে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিজিবি বলছে, তারা নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান চালান। লোকবল–সংকটের কারণে মাঝেমধ্যে সুযোগ নেন কারবারিরা।
চোরাকারবারি ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ব্রাহ্মণপাড়ার শশীদল ইউনিয়নের বাগড়া বাজারের পাশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ‘সালদা নদী বিওপি’ ক্যাম্প। ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরেই ভারত সীমান্তঘেঁষা সালদা নদী রেলস্টেশন। স্টেশনটি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার একেবারে শেষ প্রান্তে, এরপরই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার সীমানা শুরু। ভারত থেকে চোরাচালানের পণ্য এনে ওই রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয়, এমন ট্রেনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। রেলওয়ে পুলিশের এক শ্রেণির অসাধু সদস্যরাও এ কাজে সহায়তা করেন বলে যাত্রীদের অভিযোগ।
গত শনিবার দুপুরে সালদা নদী রেলস্টেশনে ঢুকতেই দেখা গেল, স্টেশনসংলগ্ন ভারত সীমান্ত থেকে দুজন ব্যক্তি প্রকাশ্যে মাথায় করে ভারতীয় চিনির বস্তা নিয়ে স্টেশনের দিকে আসছেন। তাঁদেরই একজন শ্রমিক বাক্প্রতিবন্ধী। চিনি আনার ছবি তুলতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আরেক ব্যক্তি এসে ‘সমস্যা হবে না’ বলে তাঁকে শান্ত করেন। ওই ব্যক্তি নিজের নাম কাউছার মিয়া বলে জানান।
কাউছার মিয়া বলেন, শুধু তিনি নন, এলাকার শতাধিক ব্যক্তি ওই কাজ করেন। স্টেশনের সঙ্গে ভারতের সীমান্তের একটি পাহাড়ি পথ আছে। সেখান দিয়ে এসব মালামাল (চিনি) আসে। ট্রেনে তুলে দিলে কুমিল্লা চলে যায়। সেখানে মালামাল গ্রহণ করার আলাদা লোক আছে। তিনি বলেন, ‘এক বস্তা মাল বেচলে আমরার ১০০ থাইক্কা ১৫০ টেকা লাভ হয়। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা কেনা পড়ে ৫ হাজার ২০০ টেকা। লেবার খরচ ১০০ থাইক্কা ১৫০। পুলিশসহ ট্রেনের লোকেরারে টেকা দেওন লাগে। কোনোরকমে কইরা খাইতাছি।’
কাউছারের সঙ্গে কথা বলার সময় চোরাকারবারে যুক্ত খোরশেদ আলম নামের আরেকজন এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমনেরা চা-নাশতা খাইয়া যান। এইডি পত্রিকায় দিয়েন না। আমরার ক্ষতি হইব। বিজিবি এহন কোনো ঝামেলা করে না। পরে আমরার মাল আটকাইব।’ তখন আনোয়ার হোসেন নামের একজন বলে ওঠেন, ‘বর্ডার এলাকায় ইতা স্বাভাবিক কাম। আমরা তো মাদক আনতাছি না। চিনি তো ভালা জিনিস। চিনি আনলে দেশের মাইনসের উপকার হয়। কয়েক টেকা কমে মানুষ কিনতারে। চিনি যে ঢুকে এইডা বিজিবি, পুলিশ, প্রশাসন—সবাই জানে। এগুলো পত্রিকায় দিয়ে আমরারে ঝামেলায় ফালাইয়েন না।’
সালদা নদী রেলস্টেশনটি কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে থানা-পুলিশের আওতাধীন। গতকাল সোমবার দুপুরে চোরাচালানের বিষয়ে কথা বলতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) মুঠোফোন নম্বরে কল করলে আতাউর রহমান নামের একজন উপপরিদর্শক (এসআই) ধরেন। তিনি বলেন, ‘ওসি স্যারের বদলি হওয়ায় আমি এখন সাময়িক দায়িত্বে আছি। ট্রেনে চোরাচালানের বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের একজন কর্মকর্তা জানান, রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী সবই জানে। অনেক সময় চোরাই পণ্য নিজেরাই ট্রেনে টেনে তোলে রেলওয়ে পুলিশ। প্রতি বস্তা চিনির জন্য তাঁরা টাকা পান। এসব অবৈধ পণ্য কুমিল্লা, লাকসাম, ফেনী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় যায়। সালদা নদী রেলস্টেশনে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসসহ দু-একটি লোকাল ট্রেন যাত্রাবিরতি দেয়। এ ছাড়া পাশের শশীদল স্টেশনে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস, নাসিরাবাদ এক্সপ্রেসসহ কয়েকটি লোকাল ট্রেন যাত্রাবিরতি দেয়। রেলওয়ে পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করেই এসব ট্রেনে চোরাচালানের পণ্য নিয়ে যাওয়া হয়।
স্টেশনের দক্ষিণ পাশে আরেক চোরাকারবারির সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সালদা নদী রেলস্টেশনটি গঙ্গানগর গ্রামে পড়েছে। গঙ্গানগর ও বাগড়া গ্রামের কয়েক শ মানুষ চোরাকারবারে যুক্ত। মাদক, চিনিসহ অন্যান্য পণ্য ট্রেনে সালদা নদী ও শশীদল থেকে বিভিন্ন এলাকায় যায়।
গঙ্গানগর গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় যা হয়, এখানেও তা–ই হচ্ছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারাই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। চিনিটা এখন বলা চলে ২৪ ঘণ্টাই আসছে। মদসহ মাদকদ্রব্য আসে রাতে।’
সালদা নদী বিওপি ক্যাম্পটি বিজিবির সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের (৬০ বিজিবি) অধীন। জানতে চাইলে ৬০ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম জাবের বিন জব্বার
বলেন, চোরাই পণ্য আসা ঠেকাতে তাঁরা নিয়মিত অভিযান চালান। প্রায় সময়ই চোরাই পণ্য জব্দ হচ্ছে। তাঁদের জনবলের সংকট আছে। এ জন্য টহল দল একদিকে গেলে অন্যদিকে চোরাকারবারিরা সুযোগ কাজে লাগান। বিষয়টি নিয়ে সামনে কঠোর অবস্থানে থেকে কাজ করবে বিজিবি।