যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মুখলেছুর রহমান বলেছেন, ১৯৬৮ সাল থেকে আমি ঢাকার একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে চাকুরি করতাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পর থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। ২৫ মার্চ রাতে আমাদের ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনের খোলা জায়গায় একটি গানের আসর ছিল। আমরা শ্রমিকরা রাত ৮টার দিকে গান শোনার জন্য সেখানে সমবেত হই। রাত ১০টার পর থেকেই সারা ঢাকা এক গুজবের নগরীতে পরিণত হলো। কেউ বলছে, শহরে আর্মি নেমেছে, কেউ বলছে, শহরে কারফিউ দিয়েছে, আবার কেউ বলছে, পাকিস্তান আর্মির সাথে গণ্ডগোলে আওয়ামীলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর সাথে সাধারণ নাগরিকও মারা গেছে ইত্যাদি। এ অবস্থায় রাত ১১টার দিকে আয়োজকরা অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিল। আমরা ভয়ে ভয়ে মেসে চলে এলাম। তখন রাত সাড়ে ১১টা বা ১২টা হবে। সারা ঢাকা শহরে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই সাথে মানুষের কান্নার আওয়াজ যেন আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুললো। সারা রাত গুলির আওয়াজ আর মানুষের কান্নার শদ্ধ শুনছি। ভোর রাতে আমরা কয়েকজন মিলে বাড়ি আসার জন্য রওয়ানা দিলাম। কিন্তু রাস্তায় নেমে দেখি বর্তমান যাত্রাবাড়ি থানার উভয় দিকেই পাকিস্তান আর্মির টহল। তাই ভয়ে আবার রুমে চলে যাই। ২৬ মার্চ সারা দিন চেষ্টা করেও আর বের হতে পারিনি। ২৭ মার্চ ফজরের আজান দেওয়ার সাথে সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সীমাহীন কষ্ট করে দুই দিন পর নারায়নগঞ্জ ও চাঁদপুর দিয়ে চৌদ্দগ্রাম বাড়িতে আসি। আমাদের নাটাপাড়া আর ভারতের রাঙ্গামুড়া এপার – ওপার। বাড়ি এসে যখন বুঝতে পারলাম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তখনি আমরা ভারতের রাঙ্গামুড়া গিয়ে জঙ্গল পরিস্কার করে কোন মতে থাকার মতো একটি মুলি বাঁশের ঘর উঠিয়ে স্ত্রীসহ বাবা-মাকে নিয়ে যাই। সেখানে পরে রেশমের ব্যবস্থাও করি। এরপর বাড়িতে এসে তমিজ উদ্দিন,নুরুল ইসলামের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আলাপ করি। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আমরা যুদ্ধ করার জন্য ভারতের রাজমঙ্গল ইয়ূথ ক্যাম্পে যাই। এখান থেকে আমাদের বিশাল ঘর যমুনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
যুদ্ধের প্রশিক্ষণ :
বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মুখলেছুর রহমান বলেন, ভারতের রাজমঙ্গল ইয়ূথ ক্যাম্পে আমরা এক সাথে ১৫০ জন ছিলাম। একদিন ঘোড়াশালের রহমান সাহেব নামে এক ব্যক্তি সকালে ক্যাম্পে এসে সবাইকে পিটিতে দাঁড় করালেন। পরে বললেন, এখানে এমন কারা কারা আছ , যারা ঢাকায় চাকুরি বা যে কোন কাজ করেছ। তখন আমরা প্রায় ১০০ জন হাত উঠাই। পরদিন আমাদের ১০০জনকে তিনি আসামের লাইলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এর মধ্যে আমাদের এলাকার ছিল নুরুল ইসলাম,সিরাজ ও সাত্তারসহ আরো কয়েকজন। সেখানে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ৪৫দিন বিভিন্ন অস্ত্র চালনাসহ গেরিলা যুদ্ধের উপর প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের ২নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার মেলাঘরে পাঠানো হয়। এখানে ৫০জন করে টিম করা হয়। আমাদের গ্রুপের কমান্ডার করা হয় আবু তাহেরকে এবং সহকারি কমান্ডার করা হয় আবদুর রশীদকে।
যুদ্ধের অণুগল্প :
যুদ্ধের অণুগল্প বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মুখলেছুর রহমান বলেন, জীবনের প্রথম যুদ্ধেই মিত্র বাহিনীর ৫০ জন সৈন্যকে আমরা হারাই। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের হেনামতী নামক স্থানে হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালি ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পটি স্থানীয়দের খুব বেশি নির্যাতন করতো। কেন্দ্রীয় ভাবে এই ক্যাম্পটি ধ্বংস করার জন্য মিত্র বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মিত্র বাহিনী আমাদের টিমকে তাদের সহায়তাকারি হিসেবে সাথে রাখে। আমাদের সোর্সের বিশ^াসঘাতকতায় হানাদারদের প্রকৃত শক্তি ও অবস্থান না জেনেই আমাদেরকে পেছনে সতর্ক অবস্থানে রেখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা, যারা মিত্র বাহিনী হিসেবে তখন পরিচিত ছিল, তারা ফায়ার ওপেন করে বসে। পাল্টা ফায়ারের মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যেই মিত্র বাহিনীর সামনের সারির ৫০ জন জোয়ান পাকিস্তান আর্মির গুলি খেয়ে ঢলে পড়ে এবং ঘটনাস্থলেই তারা মারা যায়। এক পর্যায়ে যুদ্ধের কৌশলের অংশ হিসেবে মিত্র বাহিনী গুলি করা বন্ধ করে আরো সৈন্য এবং অস্ত্র সহায়তা চায়। প্রায় এক ঘন্টার মধ্যেই ভারতের অতিরিক্ত সৈন্য এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি টিম আমাদের বহরে যোগ দেয়। পরে মিত্র বাহিনী ও আর মুক্তিবাহিনী এক সাথে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করে তাদের ক্যাম্পটি ঘুরিয়ে দেই এবং অসংখ্য হানাদার বাহিনী এখানে মারা যায়।
আরেকটি যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মুখলেছুর রহমান বলেন,নাঙ্গলকোট উপজেলার বাঙ্গড্ডা ইউনিয়নের পারিকোটে হানাদার বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এই ক্যাম্পে রাজাকাররা প্রায় এলাকার সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত। এমন অভিযোগ ছিল আমাদের কাছে। পরবর্তীতে আমাদের কমান্ডার সিদ্ধান্ত দিলেন ঐ ক্যাম্পে আমরা আক্রমণ করব। কিন্তু আক্রমণের পূর্ব দিন সোর্স জানাল , আমাদের ধারনার চেয়ে তাদের ক্যাম্পে সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশি। পরবর্তীতে আমরা এক দিন পিছিয়ে আমাদের আরেকটি গ্রুপকে সংযুক্ত করে ঠিক ফজর নামাজ পড়ে তাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করি। এই যুদ্ধ থেমে থেমে চলে একটানা বিকাল ৩টা পর্যন্ত । বিকাল ৩টার পর হানাদার বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে লাকসামের দিকে চলে যায়। পরবর্তীতে চৌদ্দগ্রাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই।
পরিচয় :
বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মুখলেছুর রহমান। পিতা আনু মিয়া ও মাতা ছায়েরা খাতুন। ১৯৪৩ সালের ১১ এপ্রিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার নাটাপাড়া গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার ২ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান ৩য় । ১৯৬৬ সালে তিনি সাফিয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি বর্তমানে ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক।