শনিবার ২০ GwcÖj ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


অস্তিত্ব সংকটে মনোহরগঞ্জের শতবর্ষী বেরুলা খাল


আমাদের কুমিল্লা .কম :
02.04.2023

আবদুর রহমান ।। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার খিলা ইউনিয়নের খিলা বাজার। প্রাচীন এই বাজারটির পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে শতবর্ষী বেরুলা খাল । যুগের পর যুগ ধরে মানুষের জন্য ছিলো কল্যাণকর এই খাল । কিন্তু সেই খালটি এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বাজারের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে খালটি এরই মধ্যে পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে। খালের ওপর প্রভাবশালীদের কেউ নির্মাণ করেছেন টিনের দোকান ঘর। আবার কেউ আরসিসি পিলার খালের মধ্যে ঢালাই করে নির্মাণ করেছেন পাকা দোকান ঘর। বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা বলছেন- গত এক দশকের মধ্যে বাজারটিতে যেন খাল দখলের প্রতিযোগীতা চলেছে। কিন্তু প্রতিটি দখলের সময়ই প্রশাসন ছিলেন নিশ্চুপ ভূমিকায়।
সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাজারটির বুক চিরে গেছে চারলেনের কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটি। মহাসড়কের পূর্ব পাশে খালটির অবস্থান। এরই মধ্যে খালের ওপর প্রভাবশালীরা দেড় শতাধিক দোকান তুলেছেন। এসব দোকানে প্রভাবশালীদের কেউ নিজেরা ব্যবসা করছেন। আবার কেউ ভাড়ায় দিয়ে প্রতি মাসে টাকা তুলছেন। একের পর এক দখলের ফলে খালটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে কোথাও কোথাও থালটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আবার কোথাও কোথাও খালটি সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে।
বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- খিলা বাজারটির প্রায় ৮০ শতাংশ পড়েছে মনোহরগঞ্জ উপজেলার অংশে। আর বাকি অংশ পড়েছে পাশের লাকসাম উপজেলায়। খাল দখল প্রসঙ্গে বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, প্রশাসন বিষয়টির দিকে নজর দেয় না। যার কারণে আমরা বাঁধা দিলেও দলখকারীরা শোনে না। সরকার থেকে খালটি কোন প্রকার লিজও দেওয়া হয়নি। এরপরও বাজারের উত্তর মাথা থেকে ও দক্ষিণ মাথা পর্যন্ত পুরো খালটিতেই অবৈধ দোকান ঘরের সারি দেখা যায়। প্রায় সময় দেখি খালের মধ্যে নতুন নতুর দোকান ঘর ওঠে। আমরা এসব বলে কী লাভ?

খিলা এলাকার কৃষক মাইনউদ্দিন বলেন, এক যুগ আগেও এই খালের পানি দিয়ে ইরি-বোরো আবাদ করেছি। এখন আর সেটি সম্ভব হয় না। পুরো খালটি দখল হয়ে গেছে। প্রশাসন কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় গত এক দশক ধরে খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলেছে। এখন বাধ্য হয়ে আমরা পুকুর-ডোবা বা মাটির নিচের পানি (ভূগর্ভস্থ পানি) উত্তোলন করে চাষাবাদ করি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেরুলা খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। ডাকাতিয়া নদীর কুমিল্লার লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজারের দক্ষিণাংশের ফতেপুর গ্রামে এর উৎসমুখ। মিশেছে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে গিয়ে সেখানকার আরেকটি খালে। শত বছরের প্রাচীন খালটি আগে থেকেই ভরাট করে আসছে প্রভাবশালীরা। গত কয়েক বছরে কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন অংশে খালটি দখল করে দোকান ও বাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে। এতে কোথাও কোথাও খালটির আংশিক ভরাট করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে।
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, যেখানে খালটি ভরাট বন্ধ ও দখলমুক্ত করে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা, সেখানে উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিগত সময়ে খালটি দখল করেছে। বিশেষ করে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটির চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়নে খালটি যেন ধ্বংসের প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক বর্ধিত করতে গিয়ে খালটির অধিকাংশ স্থান ভরাট করা হয়ে গেছে। এতে কোথাও খালটি ড্রেনে পরিণত হয়েছে, আবার কোথাও খালের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লাকসাম পৌরসভার দক্ষিণে বাতাবাড়িয়া ও ভাটিয়াভিটা এলাকায় গেলে এখন কেউ বলতে পারবে না এখানে আগে খাল ছিলো। এতে ওই এলাকার পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।
মনোহরগঞ্জের প্রবীণ ব্যক্তি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রাচীনকাল থেকে এই খালটি দিয়ে লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজার থেকে নৌকায় নোয়াখালীর চৌমুহনী বাজার পর্যন্ত মালপত্র আনা-নেওয়া হতো। এক সময় এই খালে পাল তোলা নৌকায় বসে মাঝি মধুর কণ্ঠে সুরের মায়াজাল বুনতেন। খাল থেকে পানি নিতে আসা গাঁয়ের বধূরা ঘোমটা টেনে কান খাড়া করে শুনতেন সেই গান। খিলা বাজারের মতো এভাবে বিভিন্ন স্থানে দখল এবং অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্ট নির্মাণে খালের নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় দেড় যুগ আগেই। তবে কয়েক বছর আগেও খালটির টলটলে পানিতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতেন স্থানীয় জেলেরা। সেই খাল এখন নামে আছে, বাস্তবে নেই।
এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও খাল দখলকারীরা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর ভাড়াটিয়াদের ভাষ্য- তাঁরা খাল দখলের বিষয়ে জানেন না। টাকার বিনিময়ে দোকান ভাড়া নিয়েছেন।
খালের উপর নির্মিত একটি দোকানে ফার্নিচার ব্যবসা করছেন মাসুদ আলম নামের এক ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, মাস দুয়েক আগে মাসিক চার হাজার টাকা ভাড়ায় দোকানটি নিয়েছি। দোকানটির মালিক লাকসামের রাজাপুর গ্রামের রহিম মিয়া । তিনি কীভাবে দোকান নির্মাণ করেছেন- সেটা আমি জানি না। আমি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছি।
এদিকে, অবৈধভাবে পুরো খালটি দখলের বিষয়টি জানা নেই বলে জানান মনোহরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম কমল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখছি। এরপর শিগগিরই খালটি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।