স্টাফ রিপোর্টার । । নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কৃষি জমির উপরের উর্বর মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদনে প্রভাব পড়ার পাশপাশি কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলার সরকারের খাস খতিয়ান ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ফসল নষ্ট করে ভেকু মেশিন লাগিয়ে মাটি কেটে বিক্রি করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি চক্র। এক প্রকার জোরপূর্বক ও ভয়ভীতি দেখিয়ে চক্রগুলো সাধারণ মানুষদের মুখ বন্ধ করে রেখেছে। প্রশাসনের চোখের সামনে এমন অনিয়ম হলেও তারা কোনো কথা বলছে না। প্রতিদিন শত শত ট্রাক ও মাহেন্দ্র লরি গাড়িতে মাটি তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।
প্রশাসন নীরব থাকায় ভূমি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফসলি জমির মাটি বিক্রির মহোৎসবে মেতেছে এই চক্রটি। প্রতিদিন শত শত ট্রাক লোকাল মাটির নামে কৃষি ফসলের জমির মাটি ইটভাঁটাতে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রগুলো।
এছাড়া মাটি কেটে যেসব পরিবহনের মাধ্যমে গ্রামের সড়ক দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেসব সড়কের অবস্থাও বারোটা বেজে গেছে ইতিমধ্যে।একদিকে ফসলের ক্ষেত উজাড় করে মাটি কাটছে, অন্যদিকে ভারী ভারী পরিবহনে মাটি নিয়ে আসার কারণে সড়কের চলাচলে রাস্তা ভেঙে জনদুর্ভোগে পড়ছে এলাকাবাসী। ধুলাবালিতে পরিবেশ হচ্ছে বিপর্যস্ত।
এ বিষয় কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মাদ রাজীব বলেন,এটা আইনগতভাবে বৈধ না। আমরা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় যে স্থানে মাটি কাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে,স্থানগুলো চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করবো ।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে ঘুরে দেখা যায়,কুমিল্লা জেলার লালমাই উপজেলার উত্তর বাগমারা ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামটি।এই গ্রামটি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে নিজেদের জমিতে নানা ধরণের ফসল উৎপাদন করছেন দিলীপ কুমার,তোতা মিয়াসহ শতাধিক কৃষক। এ গ্রামে মাটি কাটা মাঠের সঙ্গেই সরিষার হলুদ ফুলের সমাহার। কিন্তু তাদের সোনাফলা মাঠে শকুনের চোখ পড়েছে। মাটিখেকো ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোরপূর্বকভাবে রাতের বেলা ফসলসহ প্রকাশ্যে মাটি কেটে নিচ্ছে মাটি খেকোরা। তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চাইলে তাদের বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে একটি প্রভাবশালী চক্র।
সৈয়দপুর গ্রামের ভুক্তভোগী আমেনা আক্তার নামে এক নারী কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর অভিযোগ করেও মিলেনি কেনো সুরাহা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার জমির মাটি জোর করে রাতের আধাঁরে ভেকু দিয়ে কেটে নিয়ে যায় একই এলাকার আবদুল সাত্তার,বেলায়েত হোসেন সোহেল,তোফায়েল হোসেন জুয়েল। আমি তাদের বাঁধা দিলে তারা আমাকে হত্যার ভয়ভীতি দেখায়। আমি আমার জমিতে যেনো আবার চাষাবাদ করতে পারি তার জন্য প্রশাসনের নিকট সহযোগিতা কামনা করছি।
একই চিত্র দেখা যায়,সদর দক্ষিণ উপজেলার পূর্ব জোড়কানন ইউনিয়নের ফিরিঙ্গিরহাট,জোলাই,কমলপুরের কলিম্মা,হিম্মতপুর গ্রামে।প্রকাশ্যেদিবালোকে ও রাতের আঁধারে মাটি খেকোরা জোরপূর্বক ফসলি জমি কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
সেখানে কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন,সদর দক্ষিণ উপজেলার দড়ি বটগ্রাম এলাকার মৃত রেজ্জাক মেম্বারের ছেলে রুবেল,ফিরিঙ্গিরহাটের মোটা বাবুল ও বাগলপুরের জাকিরের নেতৃত্বে এই মাটিকাটা চলে। এদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী সদর দক্ষিণ উপজেলা প্রশাসনের নিকট সহযোগিতা চাইলে তারা দেখছে-দেখবে বলে কোন অভিযান পরিচালনা করছেনা বলে স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করেন।
এছাড়া জেলার আর্দশ সদর উপজেলার গোমতী নদীর দুইপাড়,মুরাদনগর ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ফসলি জমিতে মাটি কাটার এসব দৃশ্য এখন যেন নিয়মিত।প্রকাশ্যে এমন ফসলি জমি নষ্ট করে মাটি কেটে গুটিকয়েক অসাধু মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হলেও কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ করার অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়,রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একটি প্রভাবশালী চক্র ফসলি মাঠে লোকাল বালু ও মাটি কাটছে। তারা কিছু জমির মালিককে প্রলোভিত করছে আবার অনেকেই ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি থেকে মাটি কেটে তুলে নিচ্ছে।
তারা আরো বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে কিছু জমি কিনেছে। আর বাকিগুলো সরকারি জমি। প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের যোগসাজশে প্রতিদিন ভেকু মেশিনের মাধ্যমে মাটি কেটে পুকুর বানিয়ে ফেলা হয়েছে ফসলের মাঠ।
এ বিষয়ে কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক( সার্বিক) শাহাদাৎ হোসেন বলেন, আমরা প্রতিদিন ফসলি জমিতে মাটি কাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। সোমবার জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ২লক্ষ টাকা জরিমানা করেছি। আমরা ইতিমধ্যেই জেলার বিভিন্ন স্থানে খোঁজ খবর নিচ্ছি।এছাড়াও রাতের বেলা আইনগতভাবে অভিযান পরিচালনা করার নিয়ম না থাকায় আমরা রাতে অভিযান পরিচালনা করতে পারছি না।তবে অনুমতি ছাড়া মাটি কাটা বা কৃষি ফসলের ক্ষতি হয় এমন কাজ করতে দেওয়া হবে না।