মঙ্গল্বার ১৯ gvP© ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


লাগামহীন কাগজের দাম চ্যালেঞ্জের মুখে কুমিল্লার মুদ্রন শিল্প


আমাদের কুমিল্লা .কম :
17.11.2022

রুবেল মজুমদার ।।  করোনার পৌনে তিন বছরে সৃষ্ট সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে কুমিল্লার মুদ্রন ও প্রকাশনা শিল্প। বিশেষ করে কাগজের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় কুমিল্লার স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশকরা বেকায়দায় পড়েছেন। একই সাথে হুমকির মুখে পড়েছে মুদ্রন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান গুলো। কাগজের সীমাহীন দামের কারণে অনেক লেখক তাদের বই প্রকাশনা বন্ধ রেখেছেন। শুধু কাগজ নয়, কালি ও প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক জিনিসের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে।
কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকরা জানিয়েছেন, কাগজের দাম বাড়লেও বাড়েনি বিজ্ঞাপন ও পত্রিকার দাম। প্রিন্ট পত্রিকা এমন একটি দলিল যা যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করে রাখা যায়। কাগজের দাম বাড়ায় বর্তমানে প্রিন্ট পত্রিকা প্রকাশনা হুমকির মুখে পড়েছে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রিন্ট পত্রিকার জায়গা দখল করে নিচ্ছে অনলাইন পত্রিকা। এতে পাঠক হারাতে বসেছে প্রিন্ট পত্রিকা। একদিকে পাঠক সংকট, অন্যদিকে কাগজের দাম বৃদ্ধি। এই দু’য়ের যাতাকলে পড়েছে প্রিন্ট পত্রিকার প্রকাশনা। স্বল্প মূল্যের পত্রিকার যেখানে পাঠক দিন দিন কমছে, সেই ক্ষেত্রে কাগজের দামের সঙ্গে সমন্বয় রেখে পত্রিকার দাম বাড়াতে গেলে পাঠক খুঁজে পাওয়াটা কষ্টকর হয়ে পড়বে।
স্থানীয় বেশ কয়েকজন সম্পাদক বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের দাম বৃদ্ধির কথা বলা হলেও তাতে কাগজের এতটা দাম বাড়ার কথা নয়। এখানে কাগজ শিল্পের মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে কাগজের দাম বাড়িয়েছেন। অপরদিকে কালির দাম বৃদ্ধির কারণে বাড়ানো হয়েছে ছাপা খরচ। তাই পত্রিকা প্রকাশে সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
যদিও নগরীর নিউমার্কেট এলাকার চান্দিনা পেপার হাউসের মালিক জাহিদুর হোসেন বলেন, নির্দিষ্ট চাহিদার কারণে খাতার কাগজের বিক্রি ঠিক আছে। তবে মুদ্রণের কাজে ৮০ শতাংশ কাগজ ব্যবহার হওয়ায় আমাদের গড় বিক্রি কমে গেছে। এছাড়া নিউজপ্রিন্টের কাগজের দাম বেড়েছে অধিক হারে, ঢাকার পাইকারী মার্কেটগুলোতে চাহিদার তুলনা কম থাকায় স্থানীয় বাজারে কাগজ পেতে কষ্ট হচ্ছে। প্রয়োজন থাকলে অধিক দামে কাগজ কিনতে আমাদের ভয় হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মুদ্রণ ব্যবসা অনেক কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করেন কুমিল্লা নগরীর নিউমার্কেট এলাকার জসিম উদ্দিন নামের নামের এক মুদ্রণ ব্যবসায়ী।
কাগজ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সাপ্তাহ ধরে কাগজের দাম শুধু বেড়েছে। যে খাতা ৪০-৪৫ টাকায় কেনা যেত সেটা এখন ৭০ থেকে ৭৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ২৭০ টাকার রিম এখন প্রায় ৪২০ টাকা। এছাড়া একই ভাবে বেড়েছে নিউজপ্রিন্টে ও লেজার কাগজের দাম। তবে এ সাপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৬৫ হাজার থেকে বেড়ে ৮৭ হাজার টাকা হয়েছে। কম দামি এ কাগজের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
এদিকে মাত্র এক মাস আগে এক রিম (৮০ গ্রাম )প্রিন্টিং কাগজের দাম ছিল ১২৫০ টাকা। বর্তমানে সেই কাগজের দাম বেড়ে হয়েছে ৩৮০০ টাকা। পত্রিকার প্লেট প্রতি সিঙ্গেল ১৭৫ টাকার স্থলে এখন ১৯০ থেকে ২২০ টাকা। ছাপা খরচ ২০০ টাকার স্থলে এখন ২৫০ টাকা।
কুমিল্লার মুদ্রণ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বলেছেন, গত আগস্ট মাস থেকেই অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলছে কাগজের দাম। আগস্ট মাসে কাগজের দাম অক্টোবর মাসে এসে দ্বিগুণ হয়ে যায়। আবার নভেম্বর অর্থাৎ চলতি মাসে এসে আরেক দফা বাড়ে কাগজের দাম। অক্টোবরে ৫৫ গ্রাম কাগজের রীম ছিল ১,৭০০ টাকা। নভেম্বর মাসে এসে সেই কাগজ হয়ে যায় ২,২০০টাকা । এ সময়ে ৬১ গ্রাম ছিল ২,১০০ টাকা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৬০০ টাকা।৬৫ গ্রাম ছিল ২,৩০০ টাকা চলতি মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৮০০ টাকা। একই ভাবে ৭০ গ্রাম কাগজ ছিল ২,৭০০ টাকা যা বর্তমানে ৩,০০০ টাকা।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ের নির্বাহী সদস্য ও নেটওয়ার্কের স্বত্বাধিকারী ওয়ালি উল্লাহ রিপন বলেন,বর্তমানে যেভাবে কাগজের দাম বাড়ছে এটা অব্যাহত থাকলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। একদিকে কাগজের দাম দ্বিগুণের চেয়ে বেশী অপর দিকে সরবরাহ কম।প্রতিদিন কাষ্টমারের সাথে আমাদের কথা কাটাকাটি হয়। কাগজের দাম বাড়ার কারণে সকল অর্ডার অর্ধেক কমে এসেছে।
নগরীর চান্দিনা প্লাজার উদয়ন প্রিন্টার্সের মালিক রহমান মিয়া বলেন, গত এক সপ্তাহে প্রতি ১০০টি মলাটের কাগজের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। একই পরিমাণ আর্ট কার্ডের দামও এখন ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। ১০০টি আর্ট কার্ড মিলছে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। এক রিম রঙিন কাগজের দাম ৮৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়।
কুমিল্লা পের্পাসের ম্যানেজার মোঃ সুমন বলেন, খাতার মতো কাগজের উপকরণের দাম গত এক সপ্তাহে নতুন করে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। মাঝারি আকারের ১০০টি খাকি খামের দাম ২৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। সবকিছুর নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঢাকার বাজারে দাম বাড়ায় আমাদের স্থানীয় বাজারে ও দাম বেড়েছে ।
বাহার প্রিন্টার্সে প্রোপ্রাইটর মোঃ বাহার উদ্দিন বলেন, প্রকাশনা শিল্প পুরোপুরি কাগজের ওপর নির্ভরশীল। প্রকাশনা সংস্থাকে মার্কেট থেকে কাগজ কিনতে হয়। কিন্তু এভাবে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়াটা প্রকাশনা শিল্পে একটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রতি সপ্তাহ যে ভাবে কাগজের দাম বাড়ছে এটা আর কিছু দিন থাকলে আমাদের প্রকাশনা শিল্প হুমকির মুখে পড়বে।
দৈনিক শিরোনাম সম্পাদক নীতিশ সাহা বলেন, এক সময় সরকার পত্রিকাগুলো কাগজে ভর্তুকি দিতো, এটি এখন বন্ধ করে দিয়েছে। যে হারে কাগজ ও ছাপা খরচ বেড়েছে তাতে আমাদের নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। নিউজপ্রিন্ট কাগজের দামও বেড়েছে। এভাবে কাগজের দাম বাড়লে পত্রিকা বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। ব্যাক্তিগত মালিকানায় যারা কাগজ উৎপাদন করে তাদের উচিত এখন সংবাদপত্রের পাশে দাঁড়ানো।
তিনি আরো বলেন, কুমিল্লার একমাত্র দৈনিক হিসেবে শিরোনাম এখন নিউজপ্রিন্টে প্রকাশিত হয়। কুমিল্লার অপসেটে ছাপা কাগজ গুলোর উচিত বিলাসীতা পরিহার করে নিউজপ্রিন্টে চলে আসা। কারণ,নিউজ পেপার তো নিউজ প্রিন্টেই ছাপা হবে। এতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।
আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি বলেন, এটা একেবারেই কৃত্রিম সংকট যা সরকার ছাড়া কেউ বন্ধ করতে পারবে না। খুবই দুঃখজনক একটি ঘটনা যে, প্রতি সপ্তাহে কাগজের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। দেশে কোন কিছুর দাম এভাবেই হুট করে ডাবল হয়নি। এটি আমাদের প্রকাশনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এজন্য সরকারের উচিত দ্রুত ট্যাক্স কমিয়ে বিষয়টিকে তদারকির মধ্যে আনা।
তিনি বলেন, এ দাম বৃদ্ধির ফলে এনসিটিবিও সমস্যায় পড়বে। এ অবস্থায় সরকার যত দ্রুত পদক্ষেপ নেবে ততই ভালো হবে। না হলে প্রকাশনা শিল্প হুমকির মুখে পড়বে।