শুক্রবার ১৯ GwcÖj ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement
  • প্রচ্ছদ » sub lead 1 » স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কুমিল্লা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন !


স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কুমিল্লা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন !


আমাদের কুমিল্লা .কম :
19.08.2022

আবদুর রহমান ।।
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটির সঙ্গে মিশে আছে জেলার অসংখ্য মানুষের আবেগ-ভালোবাসার স্মৃতি। সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জেলার অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্রগুলোর একটি হিসেবে কুমিল্লা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটি সব সময়ই গুরুত্ব বহন করেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য- দীর্ঘ ৩৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত চিড়িয়াখানাটির এখন প্রাণই সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। অবস্থাটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন চিড়িয়াখানাটিকে বাঁচানোর কেউই নেই!
কুমিল্লা নগরীতে অবস্থিত চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটির কদর রয়েছে জেলার ১৭টি উপজেলার মানুষের কাছেও। ২০২০ সালে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হলে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয় চিড়িয়াখানাটিতে। এরপর থেকে অচলাবস্থার মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের মধ্যে জমি নিয়ে জটিলতার কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে জেলা পরিষদ থেকে জেলা প্রশাসন চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটির জমির মালিকানা বুঝে নিয়েছে।
এদিকে, এরই মধ্যে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়া চিড়িয়াখানাটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রন্তে নিয়ে এসে এর প্রাণীগুলোকে এখন চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে কোন সময় প্রাণীগুলোকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হতে পারে।
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কুমিল্লার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাঁরা বলছেন- কুমিল্লা জেলার জনসংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। এতো বিশাল একটি জেলায় চিড়িয়াখানা থাকবে না- এটা হতে পারে না। যেকোন মূল্যে কুমিল্লার অন্যতম এই বিনোদন কেন্দ্রটি রক্ষার দাবি করেছেন বিশিষ্টজনরা। তাঁরা বলছেন- জেলা প্রশাসন চাইলেই প্রাণ ফিরে পেতে পারে মৃতপ্রায় চিড়িয়াখানাটি। এটাকে আধুনিকায়ন করে গড়ে তোলা গেলে এখানে থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারবে।
এদিকে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে চিড়িয়াখানাটির ইজারা বাতিল করায় ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন ইজারাদার নগরীর ছোটরা এলাকার বাসিন্দা আনিছুর রহমান। তবে এখনো কোন প্রতিকার পাননি বলে জানিয়েছেন ইজারাদার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীর কালিয়াজুরি মৌজায় জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষেই ১০ একর ১৫ শতক সরকারি খাস জমিতে ১৯৮৬ সালের গোড়ার দিকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুস সালামের প্রচেষ্টায় এবং কুমিল্লার বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিত্তশালীদের সহযোগিতায় বিনোদনপিপাসুদের জন্য গড়ে তোলা হয় চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটি। ওই সময় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কুমিল্লা জেলা পরিষদ এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে জেলা প্রশাসন চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয় জেলা পরিষদকে। সেই থেকে এর তত্ত্বাবধান করছে জেলা পরিষদ। তারা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ইজারা দিয়ে আসছিলো। বর্তমানে সেখানে মাত্র ২৪টি পশুপাখি রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে তিনটি চিত্রা হরিণ, একটি ময়ূর, আটটি বিভিন্ন প্রজাতির বানর, তিনটি বাজপাখি, দুইটি মেছোবাঘ, একটি অজগর, দুটি খরগোশ, একটি কালিম পাখি ও তিনটি তিতির পাখি।
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা মোবারাক হোসেন বলেন, আগে জেলার একমাত্র চিড়িয়াখানাটিতে ছিলো চিত্রা হরিণের পাল, শিয়াল, তিনটি ময়ূর, তিনটি ঘোড়া, চারটি মেছোবাঘ, সিংহ ‘যুবরাজ’সহ অনেক পশুপাখি। এগুলো এখন আর নেই। তাই বিগত কয়েক বছ্ের সাধারণ মানুষ কুমিল্লা চিড়িয়াখানা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এটিকে নতুন রূপে সাজালে দর্শনার্থীদের ঠাঁই দেওয়া কষ্ট হবে। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চিড়িয়াখানার অধিকাংশ খাঁচা শূন্য হয়ে পড়েছে। লতাপাতায় ঢেকে গেছে দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে থাকা সিংহের খাঁচাটিও। বিশাল আকৃতির খাঁচায় সঙ্গিহীন জীবনযাপন করছে একটি মাত্র ময়ূর। এছাড়া যে কয়টি পশুপাখি আছে, সেগুলোও রয়েছে অযত্ন-অবহেলায়।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩০ লাখ টাকায় চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটি ইজারা দেওয়া হয়। গেল বছরের ৩০ জুন তিন বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জায়গার মালিকানা জটিলতায় ইজারা কার্যক্রম বাতিল করে জেলা পরিষদ। বর্তমানে জায়গাটি কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে থাকলেও চিড়িয়াখানায় থাকা পশুপাখির খাদ্য জোগান দিচ্ছে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ। এ বাবদ প্রতি মাসে তাদের খরচ হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, জায়গাটি তত্ত্বাবধানে নেওয়ার পর বড় একটি অংশে গত বছরের শেষদিকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক শাক-সবজির বাগান করেন। ওই সময় প্রায় ৬০ প্রকারের সবজি উৎপাদন হয় এই বাগানে। বর্তমানেও সেখানে শাক-সবজির চাষ করা হচ্ছে। এতে জেলা প্রশাসক লাভবান হলেও কুমিল্লাবাসী বঞ্চিত হচ্ছেন বিনোদন থেকে। চিড়িয়াখানাকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা উচিত।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, সাবেক জেলা প্রশাসক আবদুস সালাম ১৯৮৬ সালে কুমিল্লার মানুষের বিনোদনের জন্য এই চিড়িয়াখানাটি স্থাপন করেছিলেন। এজন্য কুমিল্লার মানুষ আজও তাঁকে মনে রেখেছে। জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসন দু’টোই সরকারি দপ্তর। তাই জমির মালিকানা নিয়ে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, বর্তমান জেলা প্রশাসক এটিকে বন্ধ না করে নতুন রূপে সাজাবেন কুমিল্লার মানুষের জন্য। তাহলে কুমিল্লার মানুষ আজীবন তাঁকে মনে রাখবেন। কুমিল্লায় ৬০ লাখ মানুষের বসবাস, তাদের জন্য একটি চিড়িয়াখানা থাকবে না এটি কোন কথা হতে পারে না?
তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে এখানে দৃষ্টিনন্দন চিড়িয়াখানা, বিনোদন কেন্দ্র এবং একটি আধুনিক পার্ক তৈরি করবে প্রশাসন। চিড়িয়াখানা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া কুমিল্লার মানুষ মেনে নেবে না।
কুমিল্লা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনের ইজারাদার আনিছুর রহমান বলেন, তিন বছরের জন্য ৩০ লাখ টাকায় ২০১৮ সালে ইজারা নেওয়ার পর থেকে চিড়িয়াখানার অবকাঠামোগণ উন্নয়ন এবং পশুপাখিতে সমৃদ্ধ করার জন্য জেলা পরিষদের কাছে বারবার দাবি জানানো হয়েছিল। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় সরকারি নির্দেশনার কারণে বন্ধ থাকে চিড়িয়াখানা। পরবর্তীতে তিন বছর মেয়াদ শেষের আগেই এক মৌখিক আদেশে চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটির ইজারা বাতিল করে জেলা প্রশাসন। এনিয়ে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট উচ্চ আদালতে রিট দাখিল করি। তখন আদালতের পক্ষ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তির আদেশ দিলেও এখনো কোনো সুরাহা করেননি জেলা পরিষদ।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী মো.হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কুমিল্লা চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন জেলা পরিষদ পরিচালনা করে আসছে। তবে এটি মূলত সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমি, যার মালিক জেলা প্রশাসক। যার কারণে আমরা ইজারা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক তাদের সম্পত্তি উদ্ধার করেছেন। এখন জেলা প্রশাসক এখানে পরবর্তীতে কী করবেন, সেটা তিনি ভালো বলতে পারবেন। মো.হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের তত্ত্বাবধানে যেসব পশুপাখি রয়েছে সেগুলো শিগগির চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হবে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাঁরা পশুপাখিগুলো নিতে সম্মত হয়েছেন। শিগগিরই হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো.কামরুল হাসান বলেন, জায়গার মালিক ডিসি কুমিল্লা। এতোদিন জেলা পরিষদ এখানে অন্যায়ভাবে ছিলো। আমরা জায়গাটির মালিকানা এরই মধ্যে বুঝে নিয়েছি। চিন্তা করছি এখানে সুন্দর একটি উদ্যান বানানো। এরই মধ্যে আমরা গাছপালা লাগাতে শুরু করেছি।
চিড়িয়াখানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা এখনো চিড়িয়াখানা বন্ধের বিষয়ে পুরোপুরি কোন সিদ্ধান্ত নেইনি। বিষয়টি ভেবে দেখছি কী করা যায়।