শুক্রবার ২৯ gvP© ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


আজ ৪ ডিসেম্বর দেবিদ্বার মুক্তদিবস


আমাদের কুমিল্লা .কম :
03.12.2021

সৈয়দ খলিলুর রহমান বাবুল, দেবিদ্বার।।
আজ ৪ ডিসেম্বর। দেবিদ্বার হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এদিনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমনে দেবিদ্বার হানাদার মুক্ত হয়েছি। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষ্যে দেবিদ্বার উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, দেবিদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাব’র উদ্যোগে নানা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। শনিবার সকাল ১০টায় র‌্যালী, মুক্তিযুদ্ধ চত্বর ও গণকবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ শেষে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনগুলোতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল। তারই ধারাবাহিকতায় দেবিদ্বার এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল ৪ডিসেম্বর। ৩ডিসেম্বর বিকেল থেকেই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। ওই দিন রাতে মুক্তিবাহিনী ‘কুমিল্লা- সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক’র কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিষ্ফোরনে উড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা হয়ে দেবিদ্বারে আসে। আক্রমণে টিকতে না পেরে রাতেই হানাদাররা দেবিদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ দেবিদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ার সংবাদে ৪ ডিসেম্বর ভোর থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ এবং হাজার হাজার জনতা স্বাধীন বাংলার পুাকা নিয়ে থানা সদর অভিমূখে আসতে থাকে এবং ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে বিজয়ের উল্লাসে উপজেলা সদর প্রকম্পিত করে তোলে।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১-এর ৩১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১৫ সদস্যের পাকসেনার একটি দল কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক ধরে পায়ে হেঁটে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনাছাউনি বর্তমান কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে যাত্রা শুরু করলে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকহানাদার দলটিকে দেবিদ্বারের ভিংলা বাড়ি এলাকায় জনতা প্রতিরোধ করে। সেদিন মহাসড়কের ভিংলাবাড়ি থেকে জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ পর্যন্ত পনেরো কিলোমিটার পথে পাকহানাদারদের সাথে মুক্তিকামী জনতা এক অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। দিনব্যাপী যুদ্ধে ৩৩ শহীদ আর অসংখ্য বাঙ্গালী আহতর বিনিময়ে ১৫ পাক সৈন্য হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ৩১ মার্চ রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের বাইরে সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ বাজি রেখে বিজয় ছিনিয়ে আনার গৌরব অর্জন করে দেবিদ্বার বাসী।
১৪ এপ্রিল ঐতিহ্যমণ্ডিত বরকামুা গ্রামে পাকহানাদাররা আক্রমণ চালায়। এ খবর পেয়ে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আবদুল হাফেজ ও আবদুল হালিম পুলিশের নেতৃত্বে হাজার হাজার বাঙালি মাত্র দুটি থ্রি-নট থ্রি রাইফেল ও লাঠি হাতে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে শত্রু সেনাদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পরে। রাইফেলের গুলিতে পাকবাহিনীর ৫ জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং বাকিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পিছু হটে যায়। কিন্তু ওই রাতেই পাকসেনারা পুরো বরকামুা গ্রামটিকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
৬সেপ্টেম্বর দেবিদ্বার থানার বারুর গ্রামে হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন বাচ্চু মিয়া, শহীদুল ইসলাম, আলী মিয়া, আবদুস সালাম, সফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ হোসেনসহ ৭ জন শহিদ হন।
১৭ সেপ্টেম্বর পাকসেনারা মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০জন বাঙালিকে ধরে এনে দেবিদ্বার উপজেলা সদরের বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কার্যালয়ের পাশে তাদের দিয়ে খোঁড়া একটি গর্তে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়।
পাকসেনারা ধামতী ও ভোষনা গ্রাম দুটিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ঘাঁটি বলে মনে করতো। সে কারণে ২৯নভেম্বর পাকসেনাদের একটি বিশাল বহর হঠাৎ করেই আক্রমণ করে ভোষনা গ্রামের ১৬টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং ৬জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। এ দিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রাজামেহের এলাকায় এক মাইন বিস্ফোরণে পাকসেনাদের ৭জন সদস্য নিহত হলে ওই এলাকার দু’পাশের প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকার সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
৩ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পাকহানাদারদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়।
মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর এদিন বুড়িচং বাহ্মণপাড়া হয়ে দেবিদ্বারে আসে। হানাদাররা ওই রাতেই দেবিদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন দল দেবিদ্বার সদরে প্রবেশ করে।
৪ ডিসেম্বর সকালে দেবিদ্বারের স্বাধীনতাকামী জনতা স্বাধীন বাংলার পুাকা নিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে দেবিদ্বারবাসীর অবদান ছিল প্রশংসনীয়! কুমিল্লা সেনানিবাসের নিকটবর্তী এলাকা হওয়া সত্বেও এখানে গড়ে উঠেছিলো তিনটি অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যায় দেবিদ্বার দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি- ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কমরেড আবদুল হাফেজ, পালাটানা ক্যাম্প প্রধান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আজগর হোসেন মাস্টার, আবদুল আজিজ খান, ওস্তাদ সাদিম আলী, শহীদ নুরুল ইসলাম, শহীদ শাহজাহান, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ শাহাদাতসহ অসংখ্য সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধার জন্মস্থান এই দেবিদ্বারে।