শুক্রবার ২৯ gvP© ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


শেষ বয়সে এসে দেখলাম আমি আওয়ামী লীগের কেউ না


আমাদের কুমিল্লা .কম :
16.11.2021

 

বঙ্গবন্ধুর নাম বলতেই গুমরে কেঁদে উঠলেন কুমিল্লার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ আফজল খান অ্যাডভোকেট। বয়সের ভারে ন্যূব্জ দেশব্যাপী আলোচিত এক সময়ের ঢাক সাইটের এই রাজনীতিকের এখন সময় কাটে ঘরে বসে, টেলিভিশন দেখে, পত্রপত্রিকা ও বই পুস্তক পড়ে। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাইরে বের হন না তিনি। জীবন সায়াহ্নে এসে রাজনীতির হিসেব মিলাতে গিয়ে বার বার হোঁচট খান তিনি। দলের কাছে অবহেলা আর অনাদরের কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে উঠেন আশিতিপুর এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক। জানালেন, আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে আমি এখন মন্ত্রী থাকতাম। শত কষ্টের মধ্যেও নিজের মেয়েকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি তিনি। তিনি বলেন, এই যে এখন বেঁচে আছি, এটা হলো আমার বোনাস লাইফ। কারণ, ১৯৭৪ সালে মেজর ডালিম ধরে নিয়ে আমাকে যেভাবে নির্মম নির্যাতন করেছে, সেদিন যদি আল্লাহর রহমতো আর বঙ্গবন্ধুর সরাসরি সহযোগিতা না থাকত তাহলে এখন আমার নামের পাশে মরহুম কথাটি লেখা থাকত। সেদিন আমাকে বাঁচানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সরাসরি এয়ার ফোর্সের চিফের হেলিকপ্টার দিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর অন্যতম সদস্য তোফায়েল আহমেদকে কুমিল্লা পাঠিয়েছিলেন। বয়সের কারণে স্মৃতিশক্তিও কিছুটা প্রতারণা করছে বলে অনেক কিছু মনে আনতে পারছেন না তিনি। যতটুকু বলতে পারছেন তার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর স্নেহধন্য অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাজনীতি করার সুযোগ পাওয়া ও তার বার বার সান্নিধ্যে যাওয়ার সৌভাগ্যবান রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ আফজল খান অ্যাডভোকেট কেন অবহেলার শিকার হলেন? কি তার দু:খ-কষ্ট এবং বর্তমানেই বা তার সময় কাটে কীভাবে? তা জানতে এবং জানাতে সোমবার রাতে এই প্রতিবেদক কুমিল্লা নগরীর ঠাকুরপাড়াস্থ তার বাসায় গিয়ে কথা বলেন। এ সময় গত ৬ দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন অ্যাডভোকেট আফজল খান। বার বার বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়া এই নেতার কথা থেকে উঠে এসেছে গত ৬ দশকের কুমিল্লার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক অজানা কাহিনিও। এ সময় এই প্রতিবেদকের সাথে ছিলেন দৈনিক আমাদের কুমিল্লার স্টাফ রিপোর্টার আবদুর রহমান ও সুফিয়ান রাসেল।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুমিল্লায় হাতেগোনা যে কয়েকজন নেতাকর্মীকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন অধ্যক্ষ আফজল খান অ্যাডভোকেট তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি যখনি আফজল খানকে দেখতেন কাছে ডেকে নিয়ে গালে টান দিয়ে বলতেন, কিরে সব ঠিক আছেনি? আর আফজল খান বঙ্গবন্ধুকে দেখা মাত্র পা ছুঁয়ে সালাম করতেন। এ সময় তাদের সম্পর্ক হয়ে উঠত গুরু-শিষ্যের মতো। বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটে যখনি কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতেন তখন তাঁর ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল কুমিল্লার অ্যাড.আহমেদ আলী সাহেবের বাসা। বঙ্গবন্ধু ফোন করে ভাষা সৈনিক আহমেদ আলী সাহেবকে বলে দিতেন, আমি কুমিল্লা আসতেছি। আফজলকে খবর দিয়ে রাখিও, আর তোমার মেয়েদের বলিও আমার জন্য খাস্তা বিস্কুট আর দুই কাপ রং চা রেডি রাখত।
বঙ্গবন্ধুর সেই স্নেহধন্য আফজল খানের বর্তমানে রাজনৈতিক পরিচয় দেয়ার মতো কোন অবস্থান নেই। তিনি বর্তমান কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ কিংবা কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের কোন দলীয় পদ-পদবিতে নেই। এমন কি এই দুই সাংগঠনিক কমিটির একজন ন্যূনতম সদস্য হওয়ারও সুযোগ হয়নি তার। এ কথা মনে হলেই নীরবে নিভৃতে চোখের পানি ছাড়েন আর বঙ্গবন্ধুৃর কথা মনে করেন। ভাবেন আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে তার আফজল মন্ত্রী সভায় থাকতেন।
অধ্যক্ষ আফজল খান। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম আহ্বায়ক। জেলা চৌদ্দ দলের সমন্বয়কও। তিনি এক সময় কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন। ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র-ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত ভিপিও। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এর প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামেই কুমিল্লায় ছিল তার অবিস্মরণীয় ভূমিকা। এই সময়ে তিনি যতটা না পদ পদবি গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলেন তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন অন্যকে পদ পদবি পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে। তিনি ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লা সদর আসন থেকে ১৯৮৬ সালে এমপি ও ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন করেছিলেন।
আফজল খান অ্যাডভোকেট, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে। নবম শ্রেণিতে থাকার সময়ই ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে পদাপর্ণ করেন তিনি। ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে চলে আসেন নেতৃত্ব পর্যায়ে। কলেজের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামেই প্রথম সারিতে ছিলেন আফজল খান। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে কুমিল্লায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। এ সময় অন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের অধ্যক্ষ আবদুর রউফ, মফিজুর রহমান বাবলু, ছাত্র ইউনিয়নের আলহাজ ওমর ফারুকসহ অন্যান্যরা। এ সময় তাদের নেতা ছিলেন কাজী জহিরুল কাইয়ুম, অ্যাড.আহমেদ আলী, মীর হোসেন চৌধুরী ও আবদুল আজিজ খান প্রমুখ।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে আফজল খান অ্যাডভোকেট বলেন, সেই সকল আন্দোলন সংগ্রামের কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এখনকার প্রজন্ম তো কল্পনাও করতে পারবে না আমরা কী পরিমাণ কষ্ট করেছি, ত্যাগ স্বীকার করেছি সেই সময়। পুলিশের ভয়ে কত দিন যে ধানের খড়ের ভিতর লুকিয়ে থেকে রাত পার করেছি তার কোন হিসেবে নেই। এক দিকে তীব্র মশার কামড় অপর দিকে খড়ের কারণে শরীরে চুলকানি কী অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে সেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন করেছিলাম। দারোগাবাড়ির আবাদ মিয়া ছিল সেই সময়ের সরকারের খুবই আস্থাভাজন ব্যক্তি আবার আমাদের সাথেও খাতির ছিল। সারাদিন শহরে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করে গ্রেফতারের ভয়ে সন্ধ্যায় গিয়ে আবাদ মিয়ার বাড়িতে উঠতাম। তাকে আমরা দাদা ভাই বলে ডাকতাম। তখন তিনি ধমক দিয়ে বলতো- “সারা দিন সরকারের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে শহরটাকে অস্থির করে শালারা এখন আইছে আমার বউয়ের সাথে প্রেম করতে। রাখ, এখনি আমি পুলিশ ডাকছি”; এরপর চলতো আবাদ মিয়ার সাথে আড্ডা। আমরা ফজরের আযান দিলেই আবার চলে আসতাম। এখনকার মতো তখন কুমিল্লা শহর এতেঠ ঘনবসতি ছিল না। বিভিন্ন এলাকায় ঝোপ জঙ্গল ছিল। আমরা মিছিল মিটিং করে কতবার সেই সকল ঝোপ জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলাম, কত পোকার কামড় খেয়েছি তার কোন হিসেব নেই। সেই সব আন্দোলন সংগ্রাম আজ অতীত। তখন আমাদের নেতারা বেশি টাকা দিতে পারত না। তখন আমাদের খাস্তা বিস্কুট, মুড়ি চানাচুর, কিংবা লুচি সিঙাড়া খাওয়ালেই খুশি হয়ে যেতাম।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঢাকার রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আফজল খান বলেন, ঢাকায় যখনি বড় সভা সমাবেশ হয়েছে। তখন বঙ্গবন্ধু অর্ডার দিতেন নেতাদের লোক নিয়ে যাওয়ার জন্য। শাসনগাছা বাস টার্মিনাল থেকে ২০/২৫ গাড়ি ভরে নেতাকর্মী নিয়ে আমরা ঢাকা যেতাম।৭ মার্চ সকালে আমরা প্রায় ৩০টি বাসের মতো নেতাকর্মী নিয়ে ৩টি ফেরি পাড়ি দিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যাই। তবে আমরা রেসকোর্সে ঢুকতে পারিনি। আমরা যাওয়ার আগেই রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। আমরা এর আশেপাশে অবস্থান নেই।
স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে আফজল খান অ্যাডভোকেট বলেন, ৭ মার্চের পর থেকেই আমরা বুঝে গেছি যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী আমরা জনমত গঠন করা শুরু করি। পাড়া মহল্লায় ছোট ছোট সভা সমাবেশ মিছিল করি। ২৫ মার্চ রাতে সারা কুমিল্লা শহরে ভাগ হয়ে আমরা একেক জন একেক পয়েন্টে নেতৃত্ব দিই। আমরা ছিলাম শাসনগাছা রেলগেট। রাত ১১টা কি ১২ টার পর যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মিরা নোয়াপাড়া অতিক্রম করে শাসনগাছা প্রবেশ করল তখনি আমরা খবর পেয়ে মুচিপাড়া গিয়ে আশ্রয় নেই। এই সময়ই মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শুরু হয়। শাসনগাছা মুচিপাড়া থেকে রাত ৩টার দিকে আমরা চলে যাই বুড়িচং। সম্ভবত এ সময় আমাদের সাথে আবদুল মালেক ভাই ছিলেন। পরদিন ভারতে চলে যাই। ভারতে গিয়ে নেতাদের নির্দেশে বিভিন্ন পয়েন্টে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করি।
বঙ্গবন্ধু নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বললে অ্যাড. আফজল খান বলেন, সেই সময় কাজী জহিরুল কাইয়ুম, এড.আহমেদ আলী চাচাসহ কয়েকজন নেতার বাহিরে বঙ্গবন্ধু আর যাদেরকে চিনতেন, ত্যাগী কর্মী হিসেবে জানতেন আমি আফজল খান ছিলাম তাদের একজন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বিশেষ করে তিনি জানতেন আফজলকে যে কোন দায়িত্ব দিলে সে সঠিক ভাবে সেই কাজটি করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্থ সহচর ছিলেন আহমেদ আলী চাচা। তিনি যখনি কুমিল্লা আসতেন আহমেদ আলী চাচাকে ফোন করে জানাতেন, আমি আসতেছি তুমি আফজলকে খবর দিয়ে রাখিও। আর তোমাদের মেয়েদের বলিও খাস্তা বিস্কুটের সাথে যেন দুই কাপ রং চা বানিয়ে রাখে। আহমেদ আলী চাচাকে এই দুটি কথা তিনি সব সময় বলতেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখা মাত্র পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। আর তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপরাতেন আর গালে ধরে টানতেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর।
মেজর ডালিমের নির্যাতন সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আফজল খান বলেন, ভিক্টোরিয়া কলেজে যখন ছাত্ররাজনীতি করতাম তখন আমি ছিলাম ছাত্রলীগে আর ডালিম ছিল জাতীয় ছাত্র ফোরামে(এনএসএফ)। সেখান থেকে তার সাথে আমার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ছাত্রজীবনের সেই দ্বন্দ্ব সে মনে রেখেছিল। ১৯৭৪ সালে তখন সে মেজর। কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত। আমি বার্ডে নিলামে গাছ কিনে কেটে এনে আমার বাসার সামনে রেখেছিলাম। একদিন দুপুরে আমি বাসায় ছিলাম। আমার বাসার সামনে রাখা গাছের পাতাগুলোর ভিতর সে সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলো অস্ত্র রেখে সেনাবাহিনীর কিছু জুনিয়র সদস্য দিয়ে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়, আর বাইরে প্রচার করে আমার বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র পেয়েছে। তখন সম্ভবত জরুরি অবস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য কি একটা আইন করা হয়েছিল এই মুহূর্তে মনে নেই। সেই অজুহাত পেয়েই আমাকে তুলে নিয়ে ওয়াটার ওয়াপদা রেস্ট হাউজের স্টাফ কোয়ার্টারে নিয়ে গাড়ি থেকে নামানোর সাথে সাথে লাকড়ি দিয়ে বেধড়ক মারপিট শুরু করে। শরীরের এমন কোন অংশ ছিল না আমাকে মারেনি। আমার সারা শরীর দিয়ে বন্যার পানির মতো রক্ত ঝরছে। একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার পরিবারের সবাই মনে করছে আমি মারা গেছি, আমাকে মেরে ফেলছে। এই ঘটনা খুব দ্রুত সারা দেশ হয়ে গেল। যখনি জ্ঞান ফিরেছে তখনি আবার আমাকে মারা শুরু করে। এভাবে চলল কয়েকদিন। আমার পরিবারের কেউ জানে না আমি কোথায় আছি। আমার শশুর মোহাম্মদ জান সাহেব তখন এনএসআই এর পুলিশ সুপার পদে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। তিনিও নানাভাবে আমার খোঁজ নিলেন। এরই মধ্যে খবর পৌঁছে গেল বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু ঘটনা শোনামাত্র এয়ারফোর্সের চিফের হেলিকপ্টার দিয়ে তোফায়েল আহমেদকে কুমিল্লা পাঠালেন আমার খোঁজ খবর নিতে। পরে শুনেছি, তোফায়েল ভাই সার্কিট হাউজে এসে আমার সব খবর শুনে দ্রুত ঢাকা গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমার নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে দিয়েছেন। এরপর আমার ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়েছে এবং ওইদিনই আমাকে অস্ত্র মামলা দেখিয়ে থানায় হস্তান্তর করে। পরে আমি জামিনে বের হয়ে আসি। সেই দিন যদি আল্লাহর রহমতে আর বঙ্গবন্ধুর সহযোগিতা না থাকত, তাহলে আজ আপনারা আমাকে মরহুম আফজল খান হিসেবে জানতেন।
আপনি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময় একাধিকবার আপনার বাসায় এসেছেন-এটা নিশ্চয়ই আপনার জন্য সৌভাগ্য -এই বিষয়ে মন্তব্য করতে বললে আফজল খান বলেন, সৌভাগ্য তো অবশ্যই। আজ যারা এমপি মন্ত্রী হয়ে বড় বড় পদে আছে তারা অনেকেই আমার কর্মী ছিলেন। যদিও আজ আমি আওয়ামী লীগের একজন সদস্যও না। এই কুমিল্লা শহরে এক সময় আওয়ামী লীগ বলতে আফজল খানকেই বুঝাত। জীবনে কোন দিন লোভলালসা করিনি। দলের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করেছি। আপনি সঠিক বলেছেন, আমি অবশ্যই সৌভাগ্যবান যে, বঙ্গবন্ধুর আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার বাসায় পদধুলি দিয়েছেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আপনার আর কোন চাওয়া পাওয়া আছে কিনা জানতে চাইলে কুমিল্লার বর্ষীয়ান এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বাবারে, চাওয়া পাওয়ার হিসেব মিলাতে গেলে চোখ বন্ধ হয়ে আছে। যে আওয়ামী লীগের জন্য জীবন যৌবন শেষ করলাম, শেষ বয়সে এসে দেখলাম আমি আফজল খান এই আওয়ামী লীগের কেউ না। না জেলায়, না মহানগরে। কোথায়ও আমি নেই। একজন সামান্য সদস্য হওয়ারও কি যোগ্যতা আমার নেই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে। এই কথা বলতেই আবেগোপ্লুত হয়ে উঠলেন কুমিল্লার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আফজল খান। এক পর্যায়ে চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আজ আওয়ামী লীগে আমি বড়ই অবহেলিত। অথচ এই আওয়ামী লীগের জন্য গত ৬০ বছরের ওপর জীবন যৌবন শেষ করেছি, অর্থ ব্যয় করেছি, ঠিকমতো পরিবারকেও সময় দিতে পারিনি। পরক্ষণেই চোখের পানি মুছতে মুছতে অধ্যক্ষ আফজল খান বলেন, তারপরেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি আমার মেয়েকে এমপি করেছেন, আমার চিকিৎসার খোঁজখবর নিয়েছেন। আমাকে ও আমার মেয়েকে কুমিল্লা সিটির দুটি নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। কিন্তু রাজাকার পুতের সাথে মিলে বঙ্গবন্ধুর নাম বিক্রি করে আমার উছিলায় এমপি হয়ে দলের ভিতর ষড়যন্ত্র করে আমাদের হারিয়েছেন এক হাইব্রিড। এর বিচার আল্লাহ করবে। অথচ ২০০৮ সালে আমি সুপারিশ না করলে সে দলীয় মনোনয়নও পেত না।
কুমিল্লাবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বললে কুমিল্লার প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, কুমিল্লার মানুষ খুব ভালো। আমি সবার জন্য দোয়া করি , সবাই যেন আমার জন্য দোয়া করে।