মন্তব্য প্রতিবেদন
জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ
শাহাজাদা এমরান।।
এক সময় হোয়াংহো নদীকে যেমন বলা হতো চীনের দু:খ হিসেবে, ঠিক তেমনি গোমতী নদীকেও বলা হতো কুমিল্লার দু:খ হিসেবে। কালের বিবর্তনে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় হোয়াংহো নদী নিয়ে চীনের দু:খ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে সেটি এখন চীনের অন্যতম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছে। আর কুমিল্লার গোমতী নদী কুমিল্লাবাসীর দু:খ লাগব করলেও হায়েনাদের কালো থাবা থেকে এখনো নিষ্কৃতি পায়নি গোমতী নদী।
অসাধু বালু ও মাটি দস্যুদের হীন লালসার শিকার হয়েছে এই নদী বছরে পর বছর, যুগের পর যুগ। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু কোন সরকারের আমলেই এই দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি গোমতী নদী ও তার পাড় সংলগ্ন এলাকা। এ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় মিডিয়ায় একাধিকবার সংবাদ অসংখ্যবার প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ফলাফল থেকে গেছে বরাবরই জিরোতে।
পুরাতন গোমতী তো এখন দখলদারদের কবলেই আছে। প্রতিবারই শুনি দখলমুক্ত করা হবে কিন্তু আমরা কোথায় পাব একজন ফাটাকেষ্টকে। যিনি দেবদূত হয়ে আসবেন আর ফিরিয়ে দিবেন কুমিল্লাবাসীর প্রাকৃতিক এই সম্পদ।
বর্তমানে যে গোমতী নদী আছে তার দুই পাড়ের চিহ্ন দেখতে মনে হবে বড্ড নির্মম- নৃশংসভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে নদীটিকে। রাস্তা থেকে এই নৃশংস দৃশ্যটি সবাই দেখলেও এর চেয়ে আরো যে ভয়াবহ দৃশ্য রয়েছে অনেকেই তা দেখতে পারছে না হয়তো গাছ গাছালির কারণে ।
গতকাল ৮ নভেম্বর সোমবার বিকেলে গোমতী নদীর পাড়ে সরেজমিনে ঘুরতে গিয়ে দেখা গেল একটি ভয়ানক দৃশ্য। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ডের ভাটপাড়ার পূর্বপাড়া এলাকার মারকাযুস্ সুন্নাহ্ মাদরাসার ঠিক বিপরীত পাশে বাঁধের ওপর থেকে গাছের আড়ালে নজর পড়তেই দেখা গেলো একটি ছোট ডোবার মতো যেন। কৌতুহলবশত সহকর্মী সাংবাদিক জসিম চৌধুরীকে সাথে নিয়ে আগাছা ডিঙিয়ে বাঁধ থেকে নেমে পড়লাম নিচে। নিচে নেমে পড়ে তো চোখ ছানা ভড়া। একি দৃশ্য ! এতো এক বিশাল বড় দিঘি। সামান্য একটু জোয়ার আসলেই দিঘিটি পুড়ে টুই টুম্বুর হয়ে যাবার কথা। মনে হচ্ছে, কোন গৃহস্থ তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে মাছের চাষ করার জন্য পুকুর কেটে রেখেছে। কখনো বড় ধরনের পাহাড়ি ঢল নামলে এই দিঘি পুরে যখন পানি বিপদ সীমার ওপরে উঠবে তখন কুমিল্লা নগরী আবার দু:খ পরিণত হয়ে নরকে রূপ নিতে পারে গোমতী নদী। তখন দুই চোখে পানি ফেলা ছাড়া আর করার কিছুই থাকবে না কারোরই। গোমতী নদী বাঁধ সংলগ্ন ভাটপাড়া এলাকার পূর্বপাড়ার নারী পুরুষসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলি। কারা জাতির এই মহা সর্বনাশ করেছে। স্থানীয়রা হয় প্রভাবশালীদের ভয়ে মুখ খুলছে না, নতুবা তারা প্রভাবশালী কর্তৃক সুবিধাভোগী এই অপকর্মে জড়িত থাকার কাজে। মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন এর মধ্যে নারী দুইজন। তারা নাম পরিচয় না বলে জানাল, বাবারে এরা শহরের লোক। আমরা চিনি না, জানি না। শুধু ভোর রাত হলে অসংখ্য ট্রাক্টরের আওয়াজই শুনি। পুকুরটি দেখে আঁতকে উঠলেন ৬৫ বছর বয়সের স্থানীয় এক বৃদ্ধ। তিনি বলেন, সর্বনাশ ! বর্ষাকালে যদি প্রবল পাহাড়ি ঢল নেমে বন্যা হয় তখন কিন্তু এই এক পুকুর খননই আমাদের সর্বনাশের একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সের এক গৃহিণী বলেন, ভাই আমরা এলাকার হলেও এটি যে এভাবে মাটি কেটে পুকুর করে ফেলছে তা আজকের আগে কিন্তু আমরা দেখিনি।
শুধু কুমিল্লা নয় সারা বাংলাদেশেই মাটি দস্যুরা মাটি কাটে, বালু দস্যুরা বালু উত্তোলন করে। কিন্তু তাই বলে একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ বাঁধ, যেই বাঁধটি খোদা না করুক কোন কারণে যদি বর্ষাকালে ভেঙে যায় তখন একবার চিন্তুা করুন,কুমিল্লা নগরীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা। শুধু কুমিল্লা নগরী নয় আশেপাশের কয়েকটি উপজেলা প্লাবিত হয়ে যাবে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক,পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লা,পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লা ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের সাথে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা) কুমিল্লা আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুমের নেতৃত্বে আমরা একধিকবার তাদের সাথে মতবিনিময় সভা করেছি। নগরীতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন সভা সেমিনার করেছি। সর্বশেষ গত অক্টোবর মাসে আমরা সরাসরি গোমতী নদী রক্ষার দাবিতে গোমতীর পাড়ে গিয়ে মানববন্ধন করেছি। কিন্তু সার্বিক অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাপা কুমিল্লা ও সাংবাদিকরা শুধু বলবে আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তারা শুধু শুনবে। তারা কোন কাজ করবে না। এখন পর্যন্ত আমরা কালেভাদ্রে লোক দেখানো কয়েকটি অভিযান ছাড়া আর কোন কিছুই দেখতে পাইনি।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক জনাব মো.কামরুল হাসানকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে বলব, জেলা প্রশাসক হিসেবে কুমিল্লায় আপনার অবস্থান খুব বেশি দিন না হলেও কুমিল্লার মানুষের আস্থা ও বিশ^াস ইতিমধ্যে আপনি কিছুটা হলেও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে আমার বিশ^াস। আপনার বিনয়ী ব্যবহার ও সবল কর্মতৎপরতা জেলাবাসী আপনাকে আপন ভাবতে শুরু করেছে। আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা, গোমতী নদী শুধু কুমিল্লার নয়, এটা জাতীয় সম্পদ। শুধু ডিসি হিসেবে না, দেশের একজন নাগরিক হিসেবেও এটি রক্ষা করা আপনার পেশাগত তো আছেই আমি মনে করি নৈতিক দায়িত্বও রয়েছে। যারা নদীর উঁচু ভূমিতে মাটি কেটে পুকুর করতে পারে তারা নিশ্চয়ই সৎ নাগরিক না, ভালো মানুষ না। আমি মনে করি আইনের চোখেও তারা ভয়ানক অপরাধী। এই অপরাধী এই অপকর্মটি যখনি করুক না কেন, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক ও সারা দেশের কাছে অনুকরণীয় শাস্তি দিতে হবে। যাতে এই শাস্তি দেখে লালমাই পাহাড়কাটাসহ দেশের অন্যান্য এলাকার মাটি দস্যুরা যাতে একটি সতর্কবার্তা পেতে পারে। যেন জাতীয় সম্পদ নিজের বাপের সম্পদ তারা মনে না করে। আপনিই পারেন এবং পারবেন সকল রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে এই অপরাধীদের শায়েস্তা করতে। মুষ্টিমেয় কিছু দস্যু ছাড়া কুমিল্লার আপামর জনগণ আপনার পাশে থাকবে ইনশাআল্লাহ্ । কুমিল্লার মানুষ আপনার সদয় পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে যারা গোমতীর পাড়ে মাটি কেটে পুকুর বানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলা ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক দৈনিক আমাদের কুমিল্লা।