কুমিল্লা-৭ উপ-নির্বাচন
মাসুমুর রহমান মাসুদ, চান্দিনা।।
কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনের উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিয়েই আলোচনা চলছে মাঠে ময়দানে। উপজেলা শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে চায়ের আড্ডায় উঠে আসছে নির্বাচনের খবর। সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায় সাধারণ মানুষ।
এই আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে আগামী ৭ অক্টোবর ভোটগ্রহণ করার কথা রয়েছে। এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। দলীয় মনোনয়ন কে পাবেন, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নৌকা প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
এ উপনির্বাচন নিয়ে বিরোধী জোটে কোনো আলোচনা বা তৎপরতা নেই। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীরা একেবারেই চুপচাপ রয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে শেষ পর্যন্ত এ উপ-নির্বাচন নিয়ে বিরোধী জোটের কোনো প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা উত্তর জেলা ২০ দলীয় জোটের সদস্য সচিব মাওলানা সৈয়দ আবদুল কাদের জামাল।
এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস- চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলার আহ্বায়ক মো. লুৎফুর রেজা খোকন।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন ৭ জন প্রার্থী। এরা হলেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, প্রয়াত অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এমপির ছেলে চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. সহিদ উল্লাহ, চান্দিনা উপজেলা যুবলীগের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ব্যবসায়ী জাকির হোসেন আজাদ, চান্দিনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসান মজুমদার রিপন, কুমিল্লা উত্তর জেলা যুব মহিলা লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নাজনীন আক্তার ও চান্দিনা উপজেলা কৃষকলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শাহজালাল মিঞা শিপন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের সবাই বলছেন, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দেবেন, সবাই তার পক্ষেই কাজ করবেন।
এদিকে, ৭ প্রার্থীর মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন তিন প্রার্থী। নানা কারণে অনেকেই মনে করছেন অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, মুনতাকিম আশরাফ টিটু অথবা মো. সহিদ উল্লাহ আওয়ামী লীগের টিকিট পেতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সমর্থকরা নৌকা প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে নিজেদের মতো করে নিশ্চয়তা প্রদান করছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. প্রাণ গোপালের পক্ষে মাঠে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। এবার নীরবেই কাজ করে যাচ্ছেন তার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
অপরদিকে, গত ৪ সেপ্টেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় একক প্রার্থী প্রস্তাবনা করে দলের নেতৃবৃন্দ। তারা চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু’র নাম প্রস্তাবনা করে একক প্রার্থী হিসেবে দলীয় প্যাডে লিখিতভাবে জেলা আওয়ামী লীগের মাধ্যমে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেরণ করেন। এতে ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার আওয়ামী লীগ ও দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনও তাকে সমর্থন দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মুনতাকিম আশরাফ ২০১৩ সালে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন দেশে ২০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফরে দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করেন।
এছাড়া আলোচনায় রয়েছেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. সহিদ উল্লাহ। তিনি ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। সহিদ উল্লাহ্ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্যার এ.এফ.রহমান হল ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে তিনি চাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ওই সময়ে শিবিরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় একাধিকবার শিবির ক্যাডারদের হামলার শিকার হন তিনি। সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন।
ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চান্দিনা উপজেলায় মাদক নির্মূল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে এই আসনে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চান তারা।
চান্দিনা পৌরসভার বেলাশ্বর গ্রামের মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন- ‘প্রয়াত সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ একজন ভালো মানুষ ছিলেন। উনার স্থানে আমরা একজন সৎ প্রার্থী চাই। যিনি চান্দিনার মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন।’
কাপড় ব্যবসায়ী বিজয় কৃষ্ণ দত্ত বলেন- ‘আমি চাই সুষ্ঠু ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে। এমন একজন এমপি নির্বাচিত হোক যিনি ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করবেন।’
কীটনাশক ব্যবসায়ী হাজী মো. শামীম হোসেন বলেন- ‘এই আসনে একজন ভালো মানুষ নির্বাচিত করতে চাই। যিনি দলমত নির্বিশেষে মানুষের বিপদে-আপদে পাশে থাকবেন।’
কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনটি বিভিন্ন কারণে আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদের বাড়ি এখানে। পলাতক ওই আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ আসন থেকে তিনি ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে এমপি হয়েছিলেন। আবার এ আসন থেকেই প্রয়াত এমপি অধ্যাপক আলী আশরাফ পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ফ্রিডম পার্টির সাথে লড়াই করে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছেন তিনি।
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তের সাথে যোগাযোগ করলে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘দলের মনোনয়ন না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে আমি কোন কথা বলব না।’
কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. সহিদ উল্লাহ বলেন- ‘আমি ছাত্র জীবনে শিবিরের বিরুদ্ধে এবং স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে অংশগ্রহণ করি। একাধিকবার হামলার শিকার হই। আমি শতভাগ আশাবাদী। অপর প্রার্থীদের গুণাগুণ বিবেচনায় নিশ্চয়ই নেত্রী আমাকে মূল্যায়ন করবেন।’
প্রয়াত অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এমপি পুত্র ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ অতীতেও তৃণমূলের সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। নির্বাচনী বোর্ড সব সময় তৃণমূলকেই গুরুত্ব দিয়ে নৌকার টিকিট তুলে দেন। এবার চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগ, ১৩টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা ইউনিট আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন একক প্রার্থী হিসেবে আমার নাম প্রস্তাবনা করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেরণ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি তৃণমূলের সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পাবে। এজন্য মনোনয়নের বিষয়ে আমি আশাবাদী।’
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী এ আসনে মনোনয়ন দাখিল ১৩ সেপ্টেম্বর, মনোনয়ন বাছাই পরদিন, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ২০ সেপ্টেম্বর এবং ভোটগ্রহণ ৭ অক্টোবর। আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আলী আশরাফ গত ৩০ জুলাই মারা গেলে এ আসন শূন্য হয়। ১৩ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ আসনে ভোটার সংখ্যা পৌনে তিন লাখ। এখানে ইভিএমে ভোট নেওয়া হবে।