অতিথি কলাম
দেশে টানা পাঁচ দিন ধরে প্রতিদিন দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে করোনায় ।নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যাও কমছে না ।তবে এই সময়ে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার কিছুটা কমেছে ।পহেলা জুলাই থেকে ১৪ জুলাই দুই সপ্তাহের বিধিনিষেধের ফলে চলতি সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ কমে আসার কথা ।তিন দিন ধরে শনাক্তের হার কিছুটা নিম্নমুখি ।কিন্তু এখনও তা উল্লেখযোগ্য নয় ।আরও কয়েকদিন গেলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে ।তবে ইতিমধ্যে ঈদ উপলক্ষে লকডাউন শিথিল করার ফলে বিধিনিষেধের কতটুকু ইতিবাচক ফল আসবে,তা নিয়ে সংশয় আছে ।ঈদকেন্দ্রিক যাতায়াত ও লোকসমাগম বৃদ্ধির কারণে ঈদের পর সংক্রমণ আরও বাড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই ।
করোনা সংক্রমণে মৃত্যু বাড়ছে জেলায় জেলায় ।৩৬ টি জেলায় আইসিইউ নেই ।অনেক হাসপাতালের নেই হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ।অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার পর হাসপাতালের নিয়ে আসা হয় ।দেখা যায় রোগীর আইসিইউ দরকার ।শয্যা খালি নেই ।সংকটাপন্ন এই রোগী একপর্যায়ে মৃত্যুবরণ করেন ।অনেক হাসপাতালে অক্সিজেনের যেমন অভাব আছে ,অভাব আছে চিকিৎসকের ।শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষেরই মৃত্যু হচ্ছে করোনায় ।তবে যাঁরা ষাটোর্ধ এবং হ্রদরোগ,কিডনি, ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত ,তাঁদের ঝুঁকি বেশি ।সাধারণত এ ধরনের রোগী এবং যাদের উপসর্গ জটিল ,তাদেরই হাসপাতালের ভর্তি হতে হয় ।হাসপাতালে বেশি মৃত্যু হচ্ছে ।মোট মৃত্যুর ২ দশমিক ২৪ শতাংশ হয় বাসায় ।
লকডাউন শিথিলের পর ঈদে ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে ।ঘরমুখো মানুষের এই ঢলে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না কেউ ।কোনো দেশে রোগী শনাক্তের হার টানা তিন সপ্তাহের বেশি ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ণ্ত্রণে আছে বলে ধরা হয় ।সে হিসেবে বাংলাদেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে।
এই অবস্থায় নতুন করে ভাবনার বিষয় হয়ে সামনে এসেছে ‘লং কোভিড’ ।সারা বিশ্বে প্রতিদিন করোনার শিকার হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ ।রোগ থেকে সুস্থ হওয়ার সংখ্যাও নেহাত কম নয় ।কিন্তু সুস্থ হওয়া একাংশের শরীরে আরও নতুন কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে ।যে বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা সৃষ্টি হয়েছে চিকিৎসক এবং গবেষকদের মধ্যে ।বিষয়টিকে তারা নাম দিয়েছেন লং কোভিড ।
লং কোভিড কী ?
উপসর্গযুক্ত করোনা আক্রান্তের একাংশ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরেও তাদের শরীরে নানাবিধ নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে ।যেমন,মাথা ব্যথা ,ঘন ঘন জ্বর আসা,ফুসফুসের সমস্যা (শ্বাসকষ্ট) ,চামড়ায় ফুসকুড়ির মতো কিছু হওয়া ,নতুন করে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হওয়া, অত্যধিক দূর্বলতা বিশেষ করে মাংসপেশীর দূর্বলতা,হাঁটতে গেলে অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা,সিড়ি বাইতে ও বেশি ওজন বহন করতে না পারা, মানসিক হতাশা,বিষণ্ণতা ইত্যাদি ।পরিসংখ্যান বলছে,করোনা আক্রান্ত ৮০ শতাংশই উপসর্গহীন বা অল্প উপসর্গযুক্ত ।বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে নিউমোনিয়ার লক্ষণ থাকে ।এই ২০ শতাংশের মধ্যে চার থেকে পাঁচ শতাংশ রোগী মৃত্যুবরণ করছেন ।
করোনা নিউমোনিয়া আক্রান্ত ১৫ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পর ,তাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের উপসর্গ ।যার মধ্যে ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে ।
করোনা মুক্ত হওয়ার পর রোগীদের মধ্যে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে ।ফুসফুসের সমস্যাই উদ্বেগ বাড়িয়েছে বেশি ।এই বিষয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তর গবেষণা চলছে ।
করোনা মুক্তি পরবর্তী ফুসফুসের সমস্যার সুনির্দিষ্ট কোনও ওষুধ আপাতত নেই ।উপসর্গ দেখে ওষুধ প্রয়োগ করা হলেও তেমন সাড়া মিলছে বলে জানা যাচ্ছে না ।করোনা সেরে গেলেও তার পর ফুসফুসের উপর যে ক্ষত বা প্রভাব পড়ছে তা হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন ।কারণ তার কোনও চিকিৎসা আপাতত নেই ।
মনে রাখতে হবে কোভিড সেরে গেলেও রোগীর শরীরে তার জীবানু বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে ।যার ফলে করোনা জয়ীদের শরীরে অনেক সময় নানাবিধ নতুন সমস্যা দেখা দেয় ।এইসব সমস্যা দেখা দেয়া মাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী জীবন যাপন করার বিকল্প আপাতত কিছু নেই ।
সেই অবধি স্বাস্থ্য বিধিসমূহ সঠিকভাবে মেনে চলা ছাড়া মহামারি নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় কোনও সড়ক নেই ।
লেখক : সাবেক সিভিল সার্জন , কুমিল্লা জেলা ও সাবেক পরিচালক,কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।