শাহাজাদা এমরান,কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে।।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমরা নানার বাড়িতে ছিলাম। ওইখানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের বেশ দাপট ছিল। প্রায়ই দুপুর এবং বিকালের দিকে আওয়াজ আসত এই হানাদার বাহিনী আসতেছে। তখন গ্রামের মানুষগুলো বিশেষ করে হিন্দু পরিবারের সদস্যরা পাটখেত ও বাঁশ বাগানে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। আমিও মা’র সাথে পাটখেতে লুকিয়ে থাকতাম। মা বলতেন, বাবা,কথা বলিও না। তাহলে পাঞ্জাবিরা গুলি করবে। তখন আমি ভয়ে চুপ হয়ে যেতাম। শরণার্থী হয়ে ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ১০/১৫ দিন এমনই করে লুকিয়ে রয়েছি। সে দিনের কথা মনে হলে এখনো ভয়ে আঁতকে উঠি। গত ১ নভেম্বর দুপুরে কুড়িগ্রাম শহরের শাপলা চত্বরের ইউ.এ প্লাজায় এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন শরণার্থী ও চ্যানেল আই টিভির কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি শ্যামল ভৌমিক। এ সময় সাথে ছিলেন অভিবাসন সংস্থা কুড়িগ্রামের সমন্বয়কারী রোকনউজ্জামান রুকু।
শ্যামল ভৌমিক। পিতা মন্টু লাল ভৌমিক ও মাতা মিভা ভৌমিক। পিতা মাতার এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৬৮ সালের ২৮ আগস্ট সাংবাদিক শ্যামল ভৌমিক কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার তবকপুর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার বাড়ি কুড়িগ্রাম পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের মিস্ত্রি পাড়ায়।
শরণার্থী জীবনের ঘটনা জানতে চাইলে সাংবাদিক শ্যামল ভৌমিক বলেন, আমার বাবার বাড়ি কুড়িগ্রাম শহরে হলেও তখন আমরা থাকতাম উলিপুরের নানার বাড়িতে। আমার নানার নাম সুরেন্দ্র নাথ দেব। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক ছিলেন। আমার ছিল তিন মামা। তারা হলেন, সত্যেন্দ্র নাথ দেব,নিতেন্দ্র নাথ দেব ও গীতেন্দ্র নাথ দেব। আমি তাদের কাছে খুব আদুরে ছিলাম।আমাদের এলাকায় মুসলিম লীগের দাপট ছিল। জিয়াউর রহমান আমলে মন্ত্রী মাহিদুল ইসলাম মুকুলের পিতা আবুল কাশেম মিয়া ছিলেন তখন আমাদের এলাকার মুসলিমলীগের সবচেয়ে বড় নেতা। আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন কানাই লাল,হাফিজ মিয়া,করিম মিয়া,আবদুল্লাহ সরকার সোহরাওয়ার্দীসহ আরও অনেকে। তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে উলিপুর ছিল বেশ উত্তপ্ত। আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগের মিছিল মিটিং ছিল স্বাধীনতার পক্ষে আর মুসলিম লীগের মিছিল মিটিং ছিল পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার এবং ধর্মকে সমনুন্নত রাখার পক্ষে।। ছোট ছিলাম বলে খুব বেশি স্মরণ নেই। তবে মায়ের কাছে শুনেছি,আমাদের নানার বাড়ি এলাকায় তখন হিন্দু পরিবার ছিল মাত্র ১২/১৩টি। আমার নানা মামারা এলাকায় প্রভাবশালী এবং সম্মানিত পরিবার হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সমস্ত হিসেবে পাল্টে যায়। স্থানীয় মুসলিমলীগ হিন্দু পরিবার গুলোর উপর ডিস্টার্ব করা শুরু করলেও অন্যান্য মুসলিম পরিবারগুলো ছিল অনেক ভাল। তারা তখন আমাদের দেখে শুনে রেখেছে। এপ্রিলের শুরু থেকেই এলাকায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আগমন একই সাথে রাজাকারদের অত্যাচারও বেড়ে গেল। হুট করে প্রায়ই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত ওই পাঞ্জাবিরা আসতেছে- এই কথা শুনার সাথে সাথে বজ্রের গতিতে সারা গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। তখন বাড়ির পাশের খেতগুলোতে বড় বড় পাট গাছ ছিল। যে যেভাবে পাড়ছে পাটখেতে কিংবা বাঁশ বাগানে গিয়ে আশ্রয় নিতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে থাকতে হতো। কয়েক ঘণ্টা পর যখন দেখল না কেউ নেই তখন একজন আরেকজনকে বলত,দেখতো রাস্তায় সেনারা আছে কিনা। সেনারা নেই নিশ্চিত হয়েই তখন আমরা পাটখেত থেকে বের হতাম। এমনই করে যখন ১০/১২ বার পালিয়ে বেড়াতাম তখন নানা ও মামারা সিদ্ধান্ত নিল,না এভাবে আর থাকা যাবে না। চল আমরা ওপারে চলে যাই।
সম্ভবত এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে কোন একদিন রাত ৮টার দিকে গ্রামের মুসলিম লীগারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। গ্রামের সকল হিন্দু পরিবার আমরা এক সাথে বাড়ি থেকে বের হই। সবার একমাত্র বাহন হল পায়ে হাঁটা। আমাদের উলিপুর থেকে যখন কাশিপুর গিয়ে পৌঁছি তখন কে যেন বলে উঠল সামনে আর্মিরা আছে। এ কথা শুনার সাথে সাথে আমরা রাস্তার পাশের বাঁশ বাগান বা কেউ পাটখেতে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। সব বাবা মা-ই বাচ্চাদের অনুরোধ করছে কেউ যেন কোন কথা না বলে। প্রায় ৩০/৪০ মিনিট পর যখন দেখল কেউ নেই তখন আবার হাঁটা শুরু করলাম। এখান থেকে প্রায় ৩০/৩৫ কিলোমিটার হেঁটে কুড়িগ্রাম শহরের পাশ দিয়ে যখন ধরলা সেতু পাড় হই তখন প্রায় রাত শেষ হয়ে আসে। আমি ছোট ছিলাম বলে আমাকে আমার মা-খালা ও মামারা পর্যায়ক্রমে কোলে তুলে নিয়েছে। কখনো আবার বলেছে এবার একটু হাঁট। ধরলা নদী পাড় হয়ে আমরা কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সারডোব এলাকায় পৌঁছি। সারডোব আসার পর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।আমার নানার বাড়িতে এক মুসলিম অন্ধ লোক ছিল। নানা তাকে ছোটকাল থেকে পালতেন। যখন আমরা ভারতের উদ্দেশ্যে চলে আসব, তখন নানা জানতে চাইল, আমরা তো চলে যাব, তুমি এখন কি করবা। তখন অন্ধ লোকটি বলল,আপনারা যেখানে যান আমি সেখানেই যাব। তখন তাকে নিয়েই নানা রওয়ানা হন। যেই না আমরা ধরলা নদী পার হয়ে সারডোব পৌঁছলাম সাথে সাথে সে হঠাৎ করে ঢলে মাটিতে পড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। সেদিন দেখেছি, একজন অন্ধ মুসলিম লোকের জন্য আমার নানার সে কি কান্না। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে মাটি চাপা দিয়ে আমরা আবার হাঁটা শুরু করি। কারণ, মুসলিম শরিয়ত মোতাবেক তাকে দাফন কাফনের কোন সুযোগ সেদিন ছিল না।
তিনি বলেন, আমরা আসার আগেই শুনেছি, রাস্তায় রাস্তায় চোর ছিনতাইকারী আছে। যা পায় শরণার্থীদের কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়। এ কথা শুনে আমার নানি পায়ের কাপড়ের জুতার ভিতর টাকা লুকিয়ে রেখেছিল। নানির বুদ্ধি হল, চোর ডাকাত আসলেও ছোট হিসেবে আমাকে চেক করবে না।
ভারত সীমান্ত তখনো অনেক দূরে। সবারই পেটে ক্ষুধা। সামনে একটি খোলা মাঠ ছিল। নানা ও মামারা বললেন, এই মাঠেই রান্না কর। মামিরা সবাই মিলে অনেক কষ্ট করে লাকড়ি খুঁজে ইটের ওপর চুলা বসিয়ে খিচুড়ি রান্না করল। আমাদের সাথে আসা অন্যান্য পরিবারও যার যার মতো করে খাবার তৈরি করল। যেই না খিচুড়ি খাব এমন সময় মাঠ সংলগ্ন গ্রামের মানুষজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করল, পাকিস্তানিরা আসতেছে পালাও। এ কথা শুনে কেউ আর খিচুড়ি খেল না। খাবার ফেলেই সবাই দিল দৌড়। একদিকে পেটের তীব্র ক্ষুধা, অন্য দিকে জীবনের মায়া । এক পর্যায়ে অনাহারে থেকেই আমরা আমাদের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার বালিহাটা সীমান্ত দিয়ে ভারতের গিদালদহ যাই। এই গিদালদহ হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহার জেলার একটি গ্রাম। এখান থেকে আমাদের সাথে সাথে নিগমনগর কলেজে অবস্থিত অস্থায়ী শিবির ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এখানে অনেক কষ্ট করে ৫/৬দিন থাকার পর আমাদের লালবাজার ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এই লালবাজার ক্যাম্পটি একটি চরের মধ্যে। শুধু বালু আর বালু। চারদিকে পানি। এই চরে ছোট ছোট ছাপড়ার মতো ঘর তুলে ৪/৫শত পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই ক্যাম্পেই ছিলাম। তবে আমি নানা ও মামাদের সাথে এই ক্যাম্পে থাকলেও আমার বাবা মা ছিল নিগমনগর ক্যাম্পে। শরণার্থী শিবিরের অপর্যাপ্ত খাবার দেখে বাবা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় চায়ের দোকান দিয়ে চা বিক্রি করেছে।
শরণার্থী সাংবাদিক শ্যামল ভৌমিক বলেন,লালবাজার ক্যাম্পটি কোন পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্প ছিল না। অন্য একটি ক্যাম্পের শাখা ক্যাম্প এটি। কারণ,আশেপাশের যত শরণার্থী ক্যাম্প ছিল ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি শরণার্থী আগেই ওইখানে থাকতে ছিল। তাই কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে এই চরে আমাদের জন্য একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। স্বাভাবিক ক্যাম্প গুলোতেও ছিল নানা সমস্যা। তার উপর শাখা ক্যাম্পের সমস্যারতো কোন অন্ত ছিল না। এখানে খাবারের মান এত খারাপ ছিল যা বলার কোন সুযোগ ছিল না। আমাদের মতো শিশুদের জন্য ছিল না কোন খাবার। ক্যাম্পে যাওয়ার পর থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এমন কোনদিন ছিল না আমাদের ক্যাম্পে মানুষ মারা যায়নি। মারা যাওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল বৃদ্ধ,শিশু ও সন্তান প্রসবকরা মহিলারা। এদের কাউকেই ধর্মীয় মোতাবেক জানাজা কিংবা দাহ করা যায়নি। চরের এক কোণে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখত কিংবা নদীতে ভাসিয়ে দিত। এই মৃত মানুষদের জন্য কান্না প্রতিদিনই আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠত।
তবে শরণার্থী ক্যাম্পে শিশুদের জন্য স্কুলের ব্যবস্থা করেছিল ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পের মধ্যে যারা শিক্ষিত ছিল তাদের দায়িত্ব ছিল ছোটদের ক্লাস নেয়া।
কবে নাগাদ দেশে আসলেন জানতে চাইলে চ্যানেল আই টেলিভিশনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি শ্যামল ভৌমিক বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭/৮ দিন পর আমরা দেশে আসি । এসে দেখি আমাদের বাড়িঘর কিছুই নেই। বাবা ভারত যাওয়ার পর রাজাকাররা সব জ¦ালিয়ে দিয়েছে। পরে জেলা প্রশাসন আমাদের থাকার জন্য কুড়িগ্রাম ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জায়গা করে দেয়। শুধু আমাদের না। যাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে ফেলেছিল কিংবা ভেঙে ফেলেছিল তাদেরকে বিভিন্ন স্কুল কলেজে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পরে বাবা ২/১ দিনের মধ্যে কোনরকম একটা ঘর তুললে আবার আমরা নিজের বাড়ি যাই।
সাংবাদিক শ্যামল ভৌমিক বলেন,সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রকম সুযোগ সুবিধা দিয়েছে সব ঠিক আছে। আমার দাবি, আমরা যারা ৭১ সালে শরণার্থী ছিলাম, সরকার যেন আমাদের বীর শরণার্থী উপাধি দেয়।