শনিবার ১২ অক্টোবর ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


পদ্মার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আছড়ে পড়ে বুকের সৈকতে!


আমাদের কুমিল্লা .কম :
10.08.2020

মাহফুজ নান্টু।।
বাসায় মোটর বাইকটা রেখে হেটে চললাম। কাক ডাকা ভোর। ইতস্ত করতে করতে সাংবাদিক মানিক ভাইকে ফোন করলাম। ফোন রিসিভ করলেন। বললেন তিনি তৈরি আছেন। কাপ্তান বাজার থেকে মানিক ভাই আর আমি অটোরিক্সাতে করে কান্দিরপাড় পৌঁছালাম। তখন ঘড়ির কাটায় সোয়া ৬ টা। মাসুদকে ফোন করলেন। ১৫ মিনিট পর মাসুদও আসলো। তৈয়বুর রহমান সোহেল আগেই জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ডে ছিলো। বোগদাদ বাসে করে আমরা রওনা করলাম। উদ্দেশ্য চাঁদপুর।
বাস এগিয়ে চলছে। এখন করোনাকাল। তাই আমরা আলাদা আলাদা আসনে। করোনার সময়ে অনেকদিন কোথাও ঘুরতে পারিনি। তাই মাত্র একদিন আগের হঠাৎ সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে গেলাম। বাস হেলেদুলে চলছে। বাসে উঠলেই আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আসে। কখনো কখনো ঘুমিয়ে যাই। অনেকটা নেশার মত হয়ে গেছে অভ্যাসটা। বাস লাকসাম মুদাফফরগঞ্জ পৌঁছালো। মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই বাসে উঠলেন। এখন আমরা পাঁচজন। বাসে অল্প বিস্তর কথা হলো। সকাল ৯.১৭ মিনিটে বাস চাঁদপুর পৌঁছালো।
এড. চৌধুরী ইয়াছিন ইকরাম প্রাচীন সাপ্তাহিক আমোদ-এ লেখালেখি করেন। চাঁদপুরে বাড়ি। মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের সাথে চমৎকার সম্পর্ক। আমরা চাঁদপুর যাবো শুনেই তিনি আমাদের স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা সবাই ইকরাম ভাইয়ের বাসায় ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি ইকরাম ভাই আমাদের গাইড করলেন। আমরা চাঁদপুর পুরানবাজার ঘুরে দেখছি। দু’শ বছরের পুরোনো মসজিদ দেখলাম। নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মাণ করা মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে। সামনে মূল ফটক। যেখানে লেখা রয়েছে পবিত্র কোরানের বাণী। আমরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম। শান্ত পবিত্র পরিবেশ। উপরে কোরান তেলোয়াত চলছে। পাশের দালান থেকে মসজিদটির পুরো চিত্র ধারণ করলাম। দলের সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত। মোল্লা ভাই মানিক ভাইকে ছবি তোলার জন্য আহবান জানালেন। হাসিমুখে ছবি তুললেন সবাই।

চাঁদপুর পুরান বাজারে চোখে পড়লো ঘর্মাক্ত ব্যস্ততা। সবার শরীর বেয়ে ঘাম পড়ছে। বিশ্রামের সুযোগ নেই। আমরা প্রবেশ করলাম সরিষার তেলের কারখানায়। ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল মোড়কজাত চলছে। দেখার মাঝেই মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই হাত দিয়ে সরিষার তেল পরখ করলেন। পরে নাকেও স্পর্শ করলেন। মাথা কাৎ করে সোহেলের চোখে তাকিয়ে বুঝালেন সরিষার তেলটা এক নম্বর।
চাঁদপুর পুরানবাজারে তাল দিয়ে তৈরি গোল গোল পিঠাবিক্রি হয়। লাল মিষ্টির মত দেখতে। ইকরাম ভাইয়ের আগ্রহে স্বাদ পরখ করতে ভুললেন না মানিক ভাই, মোল্লা ভাই ও সোহেল। পরে আফসোস করতে যেন না হয় তাই আমিও একটা লাল মিষ্টির মত তালের পিঠা মুখে পুরে দেই। আহ! কি স্বাদ। আরেকটা খেতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু রিজিকে ছিলো না। আর পিঠার স্বাদ! না খেলে লিখে বুঝানো সম্ভব না। মানিক ভাই জানালেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও নাকি এমন তালের পিঠা বিক্রি হয়।
চাঁদপুর পুরান বাজার থেকে আমরা বের হয়ে পদ্মার পাড়ে গেলাম। নদীর ঢেউগুলো ছলাৎ ছলাৎ করে পাড়ে আছড়ে পড়ছে। বক্ল দেয়া বেড়িবাঁধ। আমরা ছবি তুললাম। নদীতে দেখলাম জেলেদের ব্যস্ততা। ছোট-মাঝারি নৌকাগুলো নদীর বুকে ঘুরে ফিরছে। এর মাঝেই মহিউদ্দিন মোল্লা ভাই আমোদ এর ফেইসবুক পেইজ থেকে লাইভ করলেন। তার জীবনে প্রথম লাইভ। আমরা সবাই অনুভূতি ব্যক্ত করলাম। এবার ইকরাম ভাই আমাদের জন্য ট্রলার ভাড়া করলেন। আমরা লঞ্চঘাটে আসলাম। লঞ্চঘাটের চারপাশে লম্বা গাছ। শীতল ছায়ায় দর্শনার্থীরা বসে আছে। ফেরিওয়ালাদের ব্যস্ততা চোখে পড়লো। আমরা নদীরপাড়ে বসে আছি। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান কাটে। করোনার সংবাদ নিয়ে অন্তত এক ঘন্টা সবাই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিলাম। তারপরেই আবার নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার পালা। জাহাজ , লঞ্চ , স্টিমার , ট্রলারগুলো যাত্রী নিয়ে নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে। আর ছোট নৌকাগুলো ব্যস্ত মাছ ধরা নিয়ে। আমরা চেয়ে থাকি যতদূর চোখ যায়।
পদ্মার ওপাড়ে লোকালয় চোখে পড়ে। এড.ইকরাম ভাই জানালেন চোখে দেখা ওপাড়টা শরীয়তপুর। ট্রলারে যেতে দেড়ঘন্টা লাগে। মনে মনে বললাম নিশ্চযই পরের বার আসলে ট্রলারে শরিয়তপুর যাবো। দেখবো পদ্মার ওপাড়ে জীবন কেমন!

পদ্মা মেঘনার মিলনস্থল। যেখানে পানি ঘূর্ণায়মান হয়। উপরে নীল আকাশ। নীচে পদ্মা মেঘনার মিলন। পাশাপাশি বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা। দুই রকম পানির রং। এখানে স্পষ্টই প্রতিয়মান। সৃষ্টিকর্তা মহান। আমরা দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। প্রকৃতি যেখানে রুপ ঢেলে দিয়েছে দু’হাত ভরে।
এবার পালা সেই বিখ্যাত চাঁদপুর ইলিশঘাট ঘুরে দেখা। সবাই একসাথে মাছের আড়তে প্রবেশ করলাম। মুহূর্তেই আলাদা হয়ে গেলাম। মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলাম। পদ্মার রুপালী ইলিশ নিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা। কেউ নৌকা থেকে মাথায় করে মাছ নিয়ে আসছেন। কেউ বা পাল্লায় তুলে মেপে নিচ্ছেন। ছোট বড় মাঝারি রুপালী ইলিশ। মাপা শেষে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। আড়তের পাশেই বরফঘর। ইলিশ মাছ তাজা রাখতে বরফের বিকল্প নেই। ট্রাক-পিকআপ প্রস্তুত। মাথায় করে মাছ তুলে দিচ্ছে মাছঘাটে কর্মরত শ্রমিকরা। স্থানীয়রাও ইলিশ কিনতে আসেন। একটা বিষয় খেয়াল করলাম। ঘাটে কর্মরত শ্রমিক যারা মাথায় করে মাছ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা আনা নেয়া করেন, তাদের সবার স্বাস্থ্য অন্য রকম। একদম রেসলারদের মত হাট্টাখাট্টা শরীর। মোটা ও শক্ত বাহু দেখে আমি আর মোল্লা ভাই অবাক হই। তাদের শরীর চুঁইয়ে পড়ে ঘাম। পেটানো শরীর।
ইলিশ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। এবার একটু বিশ্রাম নিতে চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশনের ফ্লাটফর্মে গিয়ে বসি। মাঝেই হঠাৎ দেখা অনুজ প্রতীম সহকর্মী মহিউদ্দিন আকাশের সাথে। পারিবারিক ভ্রমণে চাঁদপুর এসেছে। আকাশের সাথে কাকতালীয় দেখা হওয়া ভ্রমনান্দনে নতুন মাত্রা যোগ হলো। এর মাঝে যোহর নামাজ আদায় করলেন মোল্লা ভাই। পেটে খুব খিদা। ইকরাম ভাই নিয়ে গেলেন মাছঘাটে। যেখানে মাছ ধরে আনা হয় সেখানেই আবার মাছ কেটে কুটে রান্না হয়। আর সেখানেই উদরপূর্তি করেন ঘাটের শ্রমিক-মালিকরা। তরতাজা ইলিশ মাছ, গরম ভাত, ডাল দিয়ে শুরু হলো আমাদের দুপুরের খাবার। ডিমওয়ালা ইলিশ মাছের টুকরোগুলো পাতে তুলে দিলেন ইকরাম ভাই। আমি ভোজন রসিক। যা হবার পরে হবে। এক এক করে চার টুকরো ইলিশ মাছ খেলাম। গল্পটা লেখার সময় খাওয়ার কথা মনে পড়ে মুখে পানি চলে আসে। অফিসে কেউ ছিলোনা বলে ঢোক গিলে ফেললাম। যা বলছিলাম আমি চারটা টুকরা খেয়েছি । মানিক ভাই, মোল্লা ভাই, সোহেল ও মাসুদ কম যায় না। গড়ে সবাই তিন টুকরো খেয়েছিলো। চেটেপুটে খেয়েছি। ওই সময় তাদের চেহারা দেখেছি আমি। একটু জোর করে বললে মানিক ভাই ও মোল্লা ভাই আরেক টুকরো করে নিতেন।
খাবার পর্ব শেষ করেছি। এবার ইলিশ মাছ কেনার পালা। ইকরাম ভাই বললেন, চকচক করলেই পদ্মার ইলিশ হয় না। তিনি বেছে বেছে আমাদেরকে পদ্মার ইলিশ কিনে দিলেন। সাহায্য করলেন মাছ ব্যবসায়ী আন্তরিক মানুষ আলী আকবর প্রধানিয়া। চাঁদপুরে গেছি। বন্ধু মিজান ফোন করলো। কষ্ট পেয়েছে বন্ধ্।ু নৌ-পুলিশে চাকরি করা বন্ধু বিপ্লব চলে আসলো। মন উজার করে কথা বলেছি বন্ধুর সাথে। ইকরাম ভাইকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠেছি। মনে মনে একরাশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি প্রিয় ইকরাম ভাইয়ের জন্য। স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য। বাসে উঠে আবারো তন্দ্রাচ্ছন্ন হলাম। মুদাফফরগঞ্জ এসেছি। মোল্লা ভাই বাস থেকে নামলেন। মনে পড়ছিলো চাঁদপুর ইলিশ ঘাটের কথা। যেখানে পদ্মার তীব্র স্রোতে বাবা-মা’র সাথে ছোট্ট শিশুকে দেখলাম। বাবা- মা মাছ ধরছে। আর পাঁচ বছরের শিশুটি কি নির্ভয়ে সেই মাছ ধরা উপভোগ করছে। জীবন যেখানে যেমন। বাসের কন্ট্রাকটরের ডাকে হুঁশ ফিরলো। জাঙ্গালিয়া বাস্ট্যান্ডে এসেছি।