শুক্রবার ২৯ gvP© ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


সবকিছু কি আর আগের মত হবে ?


আমাদের কুমিল্লা .কম :
25.07.2020

রেজাউল করিম শামিম।।
মা,সবকিছু কি আবার অগের মতো হবে না ? একটি বিজ্ঞাপনে, মায়ের কাছে ছোট্ট একটি মেয়ের প্রশ্ন। আসলে এই প্রশ্ন যেন আজ লাখো মানুষেরেই। বৈশ্বিক মহামারি করোনা কবোলিত আমাদের এই দেশেও এখন শুধুই পরিবর্তন।দৈনন্দিন সেসব পরির্ব্তনের মুখোমুখি আমরা। ইস্ত্রীবিহীন,দলামোচড়া প্যন্ট-সার্ট পরে,সেইভহীন মুখে মাক্স,হাতে গ্লাভস্ চোখে চশমা আর সেনিটাইজার নিয়ে এখন অফিসে যাওয়ায় অভ্যস্থ হয়ে গেছি। বাহন হিসাবে একক ভাবে রিক্সা। কিংবা দূর গন্তব্যে বেশি ভাড়ায় বাসে, এক সিটে একজন তাও আবার বাস সহকারীর ছিটানো সেইটাইজারের নামে রং মিশ্রিত পানি।চা না,খাবারের দোকানে না,পারতো পক্ষে শপিং মলেতো নয়ই, বাজারেও না।বাড়ির সামনে দিয়ে ভ্যানে করে আনা বিভিন্ন সওদাপাতি দিয়েই চলে যায়।নিদ্দিষ্ট কিছু কিছু জিনিষ কিনতে মাসে একবার হয়তো বড় ডিপার্টম্যন্ট ষ্টোরে যাওয়া।আতœীয়-স্বজন বাড়িতে যাওয়া,বন্ধুবান্ধবদের সাথেতো আড্ডা দেয়া বলতে গেলে হয়ইনা।অন্যদিকে বাড়ির মহিলা আর ছেলেমেয়েদেরতো আরো করুন অবস্থা।এ অবস্থাকেই ‘নিউ নরমার“ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে এবং মানিয়ে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।তার উপর,এবার আবার বন্যা!
মোটা দাগের এই সব পরিবর্তন সাধারণই মনে হয়।কিন্তু,এসববের মাঝেই অনেকের বিশাল ধ্বস নেমে এসেছে পরিবর্তনের কষাঘাতে।অনেকের দৈনন্দিন যাপিত জীবনে পরির্ব্তনটা স্বপ্ন ভঙ্গের মতই।এখন ঢাকার রাস্তায় চলতে প্রায় সময়ই একটি দৃশ্য চোখে পড়ে,তা হলো আসবাবপত্র থেকে সংসারের টুকিটাকি যা কিছু প্রয়োজনীয়,সবই একটি ট্রাকে তুলে চলে যাওয়ার দৃশ্য।মূলত তারা চলে যাচ্ছেন ঢাকা ছেড়ে।ঢাকায় থাকা জীবনে তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার। বিগত ক‘য়েক মাসে সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। দু‘বেলা খাবার জোটানোই এখন দায়।তার উপর আবার বাড়ি ভাড়া দিয়ে সাধের ঢাকায় থাকা বড়বেশি কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।প্রতিদিনই এমনি অসংখ্য পরিবার ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে ।গ্রামে -যেখান থেকে জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্ন নিয়ে একদিন পাড়ি দিয়েছিলো তারা ঢাকা।
ঢাকায় এখন আবাসিক টাওয়ার থেকে শুরু করে বড় বড় ফ্ল্যাট-এ্যপার্টম্যন্ট বা সাধারণ বাড়ি-ঘর সবখানেই টুলেট বা বাসা ভাড়া এমন কি দোকান,স্কুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠন ভাড়া কিংবা বিক্রি হবে বলে সাউনবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়।ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে লোকজন।করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়েই শুধু নয়।এর কারনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তার কারনেও।অনেকেই চারকি হারিয়েছেন,অনেকের বেতন অর্ধেকে নেমে এসছে,কিংবা অনেকে চাকরি থাকলেও বেতন পাচ্ছে না।দৈনিন্দন আয়ের যে ছোট ছোট দোকানপাট,ফুটপাতের হকার,বাড়িতে কাজ করার লোক কিংবা বিভিন্ন কাজের লেবার,দিন মজুর,রাজমিস্ত্রী-রডমিস্ত্রী জোগালী, তাদের বেশির ভাগেরই আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।বন্ধ হয়ে গেছে বইখাতা,কলম-পেন্সিলের দোকান,বইয়ের দোকান,অনেক পত্রিকা-গণমাধ্যম।আয়ের বিকল্প পথও খুঁজে পাওয়া যায়না। পেশা বদল করেও চলছেনা।প্রথম দিকে,সরকারি-বেসরকারি ভাবে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করা হতো।কিন্তু সময়টি প্রলম্বিত হওয়ায়। সব কিছু এখন সিষ্টেমের মধ্যে এসে গেছ।বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঢাকার বাইরে স্ব স্ব এলাকায় জনপ্রতিনিধি আর সরকারি কর্মচারির সমন্বয়ে তালিকা করে সাহায্য দেয়া হয়। ঢাকায় থাকা লোকেরাতো এখন আর তা পায়না। তাছাড়া অনেকেই হাত পাতায় অভ্যস্থও নয়।ফলে হাতে যা কিছু সঞ্চয় তাও শেষেএখন ফিরে যাওয়া সেই গ্রামের পথে।এছাড়া পথ কি ?
কত লোক বেকার বা কতজন ঢাকা ছাড়ছে ? কিছু দিন আগে ব্রাকের একটি জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে,ঢাকায় অবস্থানরত, ৩৬ ভাগ লোক তাদের চাকরি কিংবা কাজ হারিয়েছেন। ৩০ ভাগ লোক বেতন পাচ্ছেন না।৬২ ভাগ লোক দৈনিক কাজ করার সুযোগ হারিয়েছেন।সেখানে বলা হয়েছে ঢাকায় আয় করা লোকজনের ৮০ ভাগ মানুষই থাকেন ভাড়া বাসায়।আর সে সুযোগ নিয়ে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে।কন্জ্যুমার এ্যসোসিয়েশনের জরিপ মতে,বিগত ২৫ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে যেখানে ২০০ ভাগ, সেখানে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০০ ভাগ।এতগুলো বছরে,দেশের বিভিন্ন স্থানে বানভাসি মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারনে বাস্তুচ্যুত মানুষ ছুটে এসেছে ঢাকায়। এছাড়া,বিদেশে চাকরি,নানা ধরনের উন্নয়ণ কর্মকান্ডে নিয়োগ,এনজিও দের দেয়া সুযোগ-সুবিধাসহ বিভিন্ন কারনে অতিরিক্ত আর বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রায় মান বাড়ানো, সেই সাথে উচ্চ শিক্ষার জন্যেও অনেকে এসেছেন ঢাকায় স্বপ্ন গড়ার আকাংঙ্খা নিয়ে। মোট কথা বেকার,ভাগ্যান্বেষী,বিদ্যান্বেষী ইত্যাদি নানা পেশার মানুষ দেশের চারদিক থেকে ছুটে আসার কারনে ঢাকায় দ্রুতই বেড়েছে লোকসংখ্যা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী,‘৯১ সালে ঢাকার লোক সংখ্যা ছিলো মাত্র ৬৮ লাখ। অন্যদিকে জাতিসংঘের ওয়াল্ড অর্গেনাইজেশনের তথ্য অনুযায়ি ‘১৮ সালের হিসাবে ঢাকার লোক সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। তার মধ্যে উদ্বাস্তুই ৭০ লাখ।
অনেক অফিস বন্ধ হয়ে গেছে,অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন কি গার্মেন্টস,হাসপাতালের মতো শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে থাকতে বিক্রির নোটিশ টাঙ্গানো হয়েছে। করোনার শুরুর সাথে সাথেই সেই যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়েছে আর খুলেনি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেতন পেলেও বেসকারি প্রতিষ্ঠিানে বেতন নেই। এর সাথে জড়িত কোচিং সেন্টার, গৃহ সশিক্ষক,বইখাতাকলম বিক্রির দোকান,ছাপাখানা সবইতো বন্ধ।সংশ্লিষ্টরা বেকার।কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল,বিনোদন কেন্দ্রগুলো সবই বন্ধ। বন্ধ,সেলুন,বিউটি পার্লার।বড় বড় শমিং মলে কাষ্টমার নেই,সিনেফ্লেক্স,সিনেমা হল বন্ধ। ফলাফর কর্মচারি ছাটাই।এই অধিক সংখ্যক লোকজনের মাধ্যে বেশির ভাগ মানুষেই করোনার পরিবর্তন বিশেষ করে আর্থিক সংকটে পড়েছেনা। তারা তাদের এই পরিবর্তন নিয়ে ঢাকায় অবস্থানের মতো ব্যয়েরে সাথে মানিয়ে উঠতে পারছেনা তারা।সেই সাথে বন্যার প্রকোপ। খোদ ঢাকায় ঢুকে পড়েছে বানের পানি। নিন্মাঞ্চলের নিন্মআয়ের মানুষের নিজস্ব বাড়ি,ভাড়া বাড়িতেও পানি।ফলে এমনি দূরগতির কারনেওে অনেকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

খবরের একটি পতিবেদন এ্যডিট করতে গিয়ে বুকের ভেতর কেমন যেন একটু জ্বালা অনুভব করলাম। সেখানে দেখলাম, জামালপুরের মাদারগঞ্জের একজন,ঢাকায় থেকেছেন ১৩টি বছর। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তার সংসার। কিন্তু,চাকুরি হারিয়েছেন। হাতে থাকা কিছু টাকা দিয়ে টুকটাক ব্যবসা করার চেষ্ট করেছেন, হকারি করেছেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি ঢাকায় অবস্থান করার মতো আয় করতে পারেননি। হাতে থাকা টাকা শেষ। বাড়িভাড়া দিতে পারেন না তিনমাস। ফলে শেষ পর‌্যন্ত বাড়ি ফেরা। ১৩ বছরের সংসার,সবই একটি ট্রাকে করেই নিয়ে তার ভাড়ি ফেরা। স্বপ্ন ভঙ্গেরে বেদনা নিয়েই তার চলে যাওয়া। আর কি কখনো ফিরে আসতে পারবেন তিনি। পারবেন কি সেই আগের মতো স্বপ্ন আকড়ে, ছেলে মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতে।করোনাকাল গেলেও কি আবার সেই আগেরই মতো হয়ে যাবে সব কিছু ? নাকি সেই “ নিউ নরমাল“ নামের অস্বাভাবিকতাকেই নিতে হবে আপন করে।
লেখক:
সাবেক সভাপতি,কুমিল্লা প্রেস ক্লাব।