বৃহস্পতিবার ২৮ gvP© ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement


শরণার্থীদের খোঁজে… ২৬ : রাজাকাররাই আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়-নারায়ণ কর্মকার শিবু


আমাদের কুমিল্লা .কম :
26.03.2020

শাহাজাদা এমরান।। আমাদের বাড়ি মুরাদনগর হলেও থাকতাম কুমিল্লা শহরে। করতাম স্বর্ণের দোকানে কাজ।যুদ্ধের সময় শহরে থাকা অনিরাপদ ভেবে চলে আসি মুরাদনগরে। কিছু দিন থাকার পর এখানেও যখন থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল তখন চলে এলাম দেবিদ্বার বোনের বাড়িতে। এক পর্যায়ে দেবিদ্বার থেকেও পালাতে বাধ্য হয়ে চলে আসি ভারতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন বাড়ি এলাম এসে দেখি বাড়ি ঘর কিছুই নেই। বাবা জানালেন,রাজাকাররা সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিলেন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ছালিয়াকান্দি ইউনিয়নের ছালিয়াকান্দি গ্রামের জ্ঞানন্দ্র কর্মকার ও মাতংগ বালার ছেলে নারায়ন কর্মকার।পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ১৯৪৯ সালের ২১ অক্টোবর তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।
শরণার্থী জীবনের কথা জানতে চাইলে নারায়ন কর্মকার শিবু বলেন,স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগ থেকেই আমি কুমিল্লা শহরের বর্জপুর ইউছুফ হাই স্কুল রোডের অনাথ জুয়েলার্সে কারিগড়ের চাকুরী করতাম। মার্চের শুরুতেই তখন উত্তপ্ত হয়ে উঠে শহর কুমিল্লা। প্রতিদিনই দেখতাম শহরে মিছিল মিটিং হয়।নেতাদের বক্তৃতা ছিল আক্রমনাত্মক।পদ্মা মেঘনা যমুনা,তোমার আমার ঠিকানা,পাকিস্তান লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি তখন স্লোগান দেওয়া হতো। ২৫ মার্চ রাতের পর কুমিল্লা শহরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। শহরে কার্ফু চলছে।দোকান পাঠ বন্ধ। চারদিকে শুধু হত্যাকান্ডের খবর আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কুমিল্লায় থাকা নিরাপদ মনে হল না। তাই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চললাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। বিকালে বাড়ি পৌঁছলাম।আমাকে দেখে বাবা মা আরো উৎকন্ঠিত হয়ে উঠল। যুবক ছেলেকে নিয়ে মহা সমস্যা। পাঞ্জাবীরা জানতে পারলে জানে মেরে ফেলবে। মা বললেন, সকালে তুই দেবিদ্বার চলে যাবি। দেবিদ্বারের ফতেহবাদ আমার বোনের বাড়ি। এখানে ২/১ দিন থাকার পর এখানেও পাঞ্জাবী ও রাজাকারদের অত্যাচার নির্যাতন বেড়ে গেল। পরে আমার বোন,বোন জামাই,ভাগিনা ভাগনীসহ আমার ৬/৭ জন দেবিদ্বার থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। এরপর বলদা,নয়নপুর হয়ে অনেক কষ্ট স্বীকার করে ভারতের বক্সনগর গিয়ে পৌঁছি সন্ধ্যায়। ভারতের যাওয়ার সময় বিভিন্ন গ্রামে পথে পথে মানুষ আমাদের শরণার্থীদের জল এবং শুকনা খাবার দিয়েছে। পরদিন এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বক্সনগর থানায় গিয়ে আমাদের প্রত্যেকের জন্য রেশন কার্ড করি। এরপর এখান থেকে চলে যাই বিশালঘর এলাকায়। বিশালঘর থেকে গাড়িতে করে আমার এক ঘনিষ্ট আত্মীয়ের কাকড়াবনে যাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কাকড়াবনেই থাকি। তবে রিলিফ আনতাম বক্সনগর থেকে। তখনকার সময়ের ভারতের মানুষদের প্রশংসা করে নারায়ন কর্মকার শিবু বলেন, ভারতীয়রা যদি তখন আমাদের আদর না করত তাহলে সেখানে আমাদের থাকা কোন ভাবেই সম্ভব হতো না। সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে নেতাদের বিভিন্ন আদেশ নিষেধ শুনে কাজ করে দিয়েছি। যারা রিলিফ দিতেন তাদের কাজের সহযোগিতা করেছি। তবে ক্যাম্প গুলোতে আয়তনের তুলনায় মানুষ ছিল বেশী। তাই অনেক সময় দেখতাম, ক্যাম্পের যাদের পরিবার বড় ছিল তারা পালাক্রমে ঘুমাতেন। কারণ,ছোট ঘরটিতে এক সাথে সবার জায়গায় হতো না। এমন অনেক কষ্ট ছিল। আসলে সত্যি কথা বলতে কি শরণার্থী জীবনে তো কষ্ট থাকবেই। কষ্ট ছাড়া তো শরণার্থী জীবন কল্পনাও করা যায় না।
কবে দেশে আসলেন জানতে চাইলে নারায়ন কর্মকার শিবু বলেন,২৫ ডিসেম্বর বিকালে আমরা কুমিল্লা শহরে আসি। তখন ঈশ্বরপাঠশালা স্কুলে অস্থায়ী ভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। যাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে কিংবা থাকার জায়গা নেই তারা এখানে থেকে গন্তব্য যাওয়ার পথ পরিস্কার করেছে। ২৬ ডিসেম্বর সকালেই বাড়িতে চলে যাই। গিয়ে দেখি আমাদের ঘর দড়জা কিছুই নাই। স্থানীয় রাজাকাররা আমাদের ঘর বাড়ি তখন পুড়িয়ে ফেলেছিল। আমাকে দেখে মা বাবার সে কি কান্না। তাদের ধারণা ছিল আমাকে হয়তো আর ফিরে পাবে না।
সরকারের কাছে প্রত্যাশা কি জানতে চাইলে নারায়ন কর্মকার শিবু বলেন, মুক্তিযুদ্ধ কালে যারা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার সরকার যেন তার একটি তালিকা করে জনগণকে জানিয়ে দেয়। আর আমরা যারা শরণার্থী ছিলাম আমাদের যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।