শুক্রবার ১৯ GwcÖj ২০২৪
Space Advertisement
Space For advertisement
  • প্রচ্ছদ » sub lead 2 » পাখি প্রেমিক মতিন সৈকত : পাখিকে ভালবেসে যার কেটে যায় সারা বেলা


পাখি প্রেমিক মতিন সৈকত : পাখিকে ভালবেসে যার কেটে যায় সারা বেলা


আমাদের কুমিল্লা .কম :
11.05.2017


শাহাজাদা এমরান।।
মতিন সৈকত। পেশায় শিক্ষক হলেও তার সারা অঙ্গে প্রতঙ্গে বিরাজমান পাখির  প্রতি অপরিসীম ভাল ও ভাল লাগা। পাখিকে ভালবেসেই যার কেটে যায় সারা বেলা। চলনে বলনে অত্যান্ত সাদা সিদে এই হ্যাংলা পাতলা ঘরনের এই মানুষটি  ঘরে বাহিরে , রাস্তায় কি প্রতিষ্ঠানে তিনি যেখানেই থাকেন না কেন , যদি শুনেন বা দেখেন কোন পাখি রাস্তায়, ক্ষেত খামারে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে , তখন আর তাকে আটকে রাখার সাধ্য কার। তিনি সব কাজ ফেলে সেখান যাবেন। পিতা-মাতার মমতা দিয়ে অসুস্থ্য পাখিটিকে উঠিয়ে আনবেন নিজের ঘরে। যত দিন না পাখিটি সুস্থ হয়ে মুক্ত বিহঙ্গেও ন্যায় ডানা মেলে উড়তে পারছে না তত দিন তিনি তাকে লালন পালন করবেন। এ সময়ে আপন সন্তানের যতœ নেওয়ারও সময় পান না তিনি। ধ্যান জ্ঞান অসুস্থ্য পাখিটিকে সুস্থ্য  করা নিয়ে। পরে সুস্থ্য পাখিটিকে অবমুক্ত করে দিয়েই তৃপ্তি অনুভব করেন তিনি। তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন মনের অজান্তে। লাভ করেন অনাবিল প্রশান্তি। এমনি করেই এ পর্যন্ত তিনি অবমুক্ত করেছেন ৩৫০টি পাখিকে। তাই তো এলাকাবাসী তাকে ডাকে পাখি বন্ধু হিসেবে। কৃষক বন্ধু হিসেবেও স্বীকৃত রয়েছে তার। তিনি হলেন মতিন সৈকত। পাখি বন্ধু মতিন সৈকত।
কুমিল্লা জেলার  দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের সন্তান অধ্যাপক মতিন সৈকত । বাবা মৃত কেরামত আলী ও মাতা মৃত শাহানারা বেগম। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক মতিন সৈকতের স্ত্রী জাহানারা বেগম একজন গৃহিনী। তিনি দাউদকান্দি পীরচর আতিকিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার  বাংলা বিভাগের শিক্ষক।
দাউদকান্দি উপজেলা প্লাবনভূমিতে মাছ চাষের মডেল এখন সারা দেশে। জল যেখানে মাছ সেখানে। চিল, ঈগল, বক, পানকৌড়ি, পরিযাই সহ বহু পাখির প্রধান খাদ্য মাছ হওয়ায় এখানে হাজারো পাখির বসবাস। মৎস খামারিরা চাষের ছোট মাছকে রক্ষার জন্য জাল এবং সূতা দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে রাখে। এতে অনেক পাখি আটকে আহত হয়ে ঝুলে থাকে। কখনো মারা যায়। মতিন সৈকত এসব পাখি খুঁেজ বের করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে ছেড়ে দেন।
২০০৬ থেকে  এই পর্যন্ত ১১ বছরে তিনি  ৩৫০টি নানা প্রজাতির পাখি অবমুক্ত করেন। এছাড়াও বিভিন্ন পাখি,  বন্যপ্রানী উদ্ধার, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ, খাল-নদ পূন:খননে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মতিন সৈকতের দেখাদেখি স্থানীয় শিশু কিশোররা পাখি, পরিবেশ, জীব বৈচিত্র সংরক্ষনে এগিয়ে এসেছে। এলাকায় কোন পাখি আহত বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে  ডাক পরে পাখিদের প্রিয় বন্ধু মতিন সৈকতের। ডাক পাওয়ার সাথে সাথেই যেখানে থাকেন না কেন চলে আসেন তিনি।
মতিন সৈকত বলেন, ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি অনেকে সখ করে পাখি পালে। কিন্ত পাখিটি যখন অসুস্থ হয় তখন তাকে ছেড়ে দেয়। আমার এই বিষয়টি খুব খরাপ লাগত। পাখিটিতো আর তার বাবা-মাকে খুঁজে পাবে না। তবে তার চিকিৎসা করাবে কে ? এই চিন্তা থেকেই পাখির প্রতি আমার ভালবাসা, ভাল লাগা কিংবা বলতে পারেন প্রেম শুরু হয়ে যায়। যে কোন প্রজাতির পাখি অসুস্থ্য হয়েছে তা দেখলে কিংবা শুনলে আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। বিশেষ করে আমাদের দাউদকান্দি যখন প্লাবন ভুমিতে মৎস্য চাষ শুরু করে তখন লক্ষ্য করলাম যে, ছোট মাছ কে রক্ষা করার জন্য মৎস্য চাষীরা পুৃকুরের উপর জাল দিয়ে রাখে। আর সে জালে পা আটকে অসংখ্য পাখি অসুস্থ্য হয়ে যায়, জেলেদেও হাতে মারা যায়। তাই আমি পাখিদের  উদ্ধার অভিযানে নেমে যাই। আমার দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় থাকে যখন আমি বিভিন্ন জমি কিংবা পুকুরে পুকুরে ঘুরে বেড়াই। কাদা মাটি নিয়ে নেমে যাই জমির ভিতর। খুঁজে বের করি কোন অসুস্থ্য কিংবা আটকে যাওয়া পাখি আছে কিনা। প্রথম প্রথম এলাকার লোকজন আড়ালে আবঢালে আমাকে পাগল বলত। কেউ বা সখ করে বলত পাখির পাগল বলে। কিন্ত আমি কোন সমালোচনাকেই মনে ধরিনি। আমার  একটাই উদ্দেশ্য,অসুস্থ পাখিদের সুস্থ করে আকাশের দিকে ছেড়ে দেওয়া। কারণ,  পাখিদের আকাশে উড়া কিংবা গাছের ডালে মানায় বেশ। এখন এলাকার লোক আর আমাকে পাগল বলে না। তারা আমাকে পাখি বন্ধু বলে ডাকে। এটাই আমার সবচেয়ে অর্জন বলে আমি মনে করি।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ সোমবার কালবৈশাখি ঝড়ে আহত ২০টি চিল খুঁজে বের করে বাড়িতে এনে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে ২৭ এপ্রিল  বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি অবমুক্ত করেন।
অধ্যাপক মতিন সৈকত শুধু যে পাখি প্রেমিক তা নয়, তিনি একজন খাঁটি কৃষক বন্ধু। কৃষি, কৃষকের প্রতি তার অগাধ ভালবাসার কারণেই তাকে কৃষক বন্ধুর খেতাবও এনে দিয়েছে। তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
পাখি প্রেমিক মতিন সৈকত ইতিমধ্যে  পরিবেশ সংরক্ষন ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি ভাবে চট্টগ্রাম বিভাগে ২০১৫ ও ২০১৭ তে ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। কৃষিতে অবদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (২০১০) তাকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রদান করেন। সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের জন্য তিনি ১০ম শ্রেনীতে পড়ার সময় (১৯৮৭) মহামান্য রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন পত্র পান। মতিন সৈকত ১৯৯৭ থেকে স্থানীয় কৃষকদের ১৫০ বিঘা বোরো ধানের জমিতে আজ পর্যন্ত এক টানা ২০ বছর পৌষ থেকে বৈশাখ ৫ মাস সেচের পানি দেন।  বোরোধান রোপন থেকে পাকা ধান সংগ্রহ পর্যন্ত  যার যতোবার সেচের পানি প্রয়োজন ততোবার সেচের পানি সরবরাহ করে আসছেন মৌসুম ব্যাপি মাত্র ২০০ টাকা বিঘা প্রতি। অন্যত্র বোরোধানের সেচ খরচ দিতে হয় ১২০০-২০০০ টাকা। দেশে বিদেশে এতো কম মূল্যে বোরো ধান উৎপাদনে সেচ প্রদানে এটিই একমাত্র উদাহরণ বলে মতিন সৈকত জানান।
দাউদকান্দি রোটারি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোঃ নুরুল গনি বলেন,  ‘মতিন সৈকত কুমিল্লার কৃতি সন্তান, বিশিষ্ট সমাজকর্মী, কিংবদন্তী পরিবেশ বিজ্ঞানী। তিনি একাধারে একজন  পাখি প্রেমিক এবং পরিবেশ বন্ধুও।   যিনি মাত্র ২০০টাকায় প্রতি বিঘা বোরো ধানে মৌসুম ব্যাপী দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ সেচ প্রদানের মাধ্যমে অধিক ফলনশীল বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপাদনে কৃষকদেরকে অনুপ্রানীত ও উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যার নজির কখন খুজে পাওয়া যাবে না।
স্থানীয় এমপি ও  প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব:) সুবিদ আলী ভূইয়া জানান ‘মতিন সৈকত গত ২০ বছর যাবৎ পরিবেশ ও  কৃষি উন্নয়নে কাজ করে জাতি গঠনে বিশেষ অবদান রেখেছেন। আমি তার মঙ্গল কামনা করি।’ দি ক্রপ ক্রসেডার, এ রিয়েল পেট্রিয়ট, এ ম্যান টু বি ফলোইড এ্যান লাইটেড মতিন সৈকত নামে তার কাজের উপর প্রতিবেদন হয়। তাকে নিয়ে শাইখ সিরাজ, রেজাউল করিম সিদ্দিকী, রামেন্দু মজুমদার, মুন্নি সাহা, রোম্মান রশিদ- সাদিয়া ওহাব টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন। বিবিসি তার সাক্ষাৎকার প্রচার করেন। কানাডা বাংলাদেশে সেন্টার এবং এফ এ ও বাংলাদেশ তাকে অভিন্দন জানান। মতিন সৈকত দাউদকান্দি কেন্দ্রীয় আইপিএম- আইসিএম ক্লাবের সভাপতি। নিরাপদ ফসল উৎপাদন আন্দোলন বিশ মুক্ত দাউদকান্দি মডেল উপজেলা বাস্তবায়নের উদ্যোক্তা। প্লাবন ভূমিতে মৎস চাষের দাউদকান্দি মডেলের সাথে তিনি সম্পৃক্ত।